নেতৃত্বের গভীরে: শারমিন আহমদের চোখে তাজউদ্দীন আহমদ

১৯৭০ সালের নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ব্যস্ততার অন্ত ছিল না তাজউদ্দীন আহমদের। নির্বাচনের চাপ, অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয়হীন হাজারো মানুষের দেখভাল। এরই মাঝে একদিন তার কন্যা শারমিন আহমদ দেখেন, বাবার দুই হাতের তালুতে একটি মৃত বুলবুলি পাখি, আর তার চোখ বেয়ে ঝরছে জল। বাড়ির টবে থাকা মানিপ্ল্যান্টের বাসায় আশ্রয় নেওয়া পাখিটিকে ঝড়ের আগে ভেতরে আনতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সারাদিন ঠিকমতো খাননি, কেবল আফসোস করেছেন এই বলে, ‘এত লোকের আশ্রয় দিলাম লিলি, আর বুলবুলি পাখির বাসাটা ভেতরে আনতে ভুলে গেলাম!’ নিজের ব্যস্ততার জন্য অন্যকে দোষারোপ করেননি, বরং এক ক্ষুদ্র প্রাণের মৃত্যুতে তার এই গভীর বেদনা প্রকাশ করে এক বিরল মানবিকতার চিত্র।

এই মমত্ববোধ কেবল বুলবুলি পাখির প্রতিই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদের চরিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই সংবেদনশীলতা। কন্যা শারমিন আহমদের স্মৃতিতে, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি ও তার বোন হাঁটতে বের হতেন। রাস্তায় পড়ে থাকা আবর্জনা নিজ হাতে তুলে নিতেন তাজউদ্দীন, সন্তানদেরও উৎসাহিত করতেন। পথের কুকুরদের ঘরে এনে পরম যত্নে গোসল করিয়ে খাবার দিতেন। তার ভাষায়, যে নেতা সমাজের প্রতিটি প্রাণের কষ্ট, এমনকি একটি পশুপাখির বেদনাও হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত নেতা। কন্যা শারমিন আহমদ এই গুণটিকে ‘ইন্টেগ্রিটি’ বলে আখ্যা দেন—এমন এক সততা ও সৌন্দর্যবোধ যা লোকচক্ষুর আড়ালেও অমলিন থাকে।

ব্যক্তিগত জীবনের এই মানবিকতাই তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সংঘাত এড়িয়ে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার এক অনন্য কারিগর। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর জিয়াউর রহমান যখন নিজের বাহিনীর নাম ‘জেড ফোর্স’ রাখলেন, তখন সেনাপ্রধান এম এ জি ওসমানীসহ অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। তাজউদ্দীন আহমদ পরিস্থিতি সামাল দেন অন্য সেক্টর কমান্ডারদের নামে ‘কে ফোর্স’ ও ‘এস ফোর্স’ গঠন করে সমতা এনে। ঠিক একইভাবে, গ্রামে এক ব্যক্তির বন্দুকের ভুলে এক কিশোরের মৃত্যুর পর দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে তিনি যেভাবে ভালোবাসা ও সমঝোতার সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, তা আজও বিদ্যমান।

তার এই নেতৃত্ব আকস্মিকভাবে তৈরি হয়নি। শৈশব থেকেই প্রখর মেধার অধিকারী তাজউদ্দীন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তৎকালীন সারা বাংলায় ১২তম এবং ইন্টারমিডিয়েটে ঢাকা বোর্ডে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করার পর জেল থেকে অংশ নিয়ে আইনেও উত্তীর্ণ হন। নিয়মিত ডায়েরি লেখা, সভা-সমাবেশে যোগদান এবং তরুণ-প্রবীণ সকলের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক থেকে শুরু করে সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সবশেষে সাধারণ সম্পাদকের পদে তিনি এসেছিলেন অর্থ বা প্রভাবের জোরে নয়, বরং একেবারে তৃণমূল থেকে, একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন সময়ে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে নিজ দলের ভেতর থেকেও প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত একটি অংশ প্রতিনিয়ত তার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সকলকে নিয়ে কাজ করার নীতিতে অটল ছিলেন। শিলিগুড়ি সম্মেলনে অধিকাংশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সমর্থন আদায় করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, তার নেতৃত্বই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি।

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার বড় মেয়ে শারমিন আহমদের সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের এই আলাপচারিতায় একজন আপাদমস্তক মানবিক ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের এমনই সব অজানা অধ্যায় উঠে এসেছে।