২০২৪ সালের ২৫ জুলাই: সারাদেশে গণগ্রেপ্তার, মৃত্যু ২০৩!

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যে ২৫ জুলাই ২০২৪ তারিখে দেশব্যাপী ব্যাপক গণগ্রেপ্তার চালানো হয়। ১৭ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ৯ দিনে সারাদেশে অন্তত পাঁচ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শুধু ২৫ জুলাইতেই, সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগে ১২৮টি নতুন মামলায় ৪৫১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। এর মধ্যে রাজধানীতেই গ্রেপ্তার করা হয় ২,২০৯ জনকে। এছাড়া চট্টগ্রামে ৭৩৫, বরিশালে ১০২, নরসিংদীতে ১৫৩ এবং সিলেটে ১২৮ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করে। শুধু ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানাতেই সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ২০১টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

আন্দোলনের পরিসর বাড়ছে, দাবি যুক্ত হচ্ছে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের নামে এই দিনে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আন্দোলন কেবল কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ নেই। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, গুম-খুন, ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, মামলা প্রত্যাহার, আহত ও নিহতদের পরিবারকে সহায়তা এবং ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী রাজনীতির অবসানের দাবিতেও আন্দোলন চলবে।

‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’এর এক বিবৃতিতে জানানো হয়, গত ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে আংশিক বিজয় এসেছে। এই বিবৃতিতে ৯১ জন শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর রয়েছে।

মৃত্যু বেড়ে ২০৩, আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

২৫ জুলাই চিকিৎসাধীন আরও তিনজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৩ জনে (সূত্র: দৈনিক সমকাল)। ঢামেক হাসপাতাল মর্গ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৮৫টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এদিন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে জানায়, বিক্ষোভ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তদন্তের দাবি জানান।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতা নিয়ে স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানান।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, “বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর আমরা তীক্ষ্ণ নজর রাখছি এবং দ্রুত শান্তি ফিরে আসবে বলে আশা করি।”

কারফিউ শিথিল, সেনা টহল বজায়

চলমান কারফিউ ২৫ জুলাই শিথিল করে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত করা হয়। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে শুক্র ও ২৬ জুলাইও কারফিউ বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

এদিন রাজধানীতে সেনাবাহিনীর কঠোর টহল বজায় ছিল। শহরের বিভিন্ন মোড়ে বসানো হয় চেকপোস্ট, তল্লাশি চলে দিনভর। যদিও কারফিউ শিথিল সময়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে শহর। খোলা ছিল অফিস-আদালত, চালু ছিল গণপরিবহন।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) লঞ্চ চলাচল চালু করলেও বাংলাদেশ রেলওয়ে জননিরাপত্তার কথা বিবেচনায় ট্রেন চলাচলের পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শন ও বিবৃতি

২৫ জুলাই সকালে মিরপুর-১০ নম্বরে ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আমি জনগণের কাছে বিচার চাই।”

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, প্রধানমন্ত্রী আহতদের চিকিৎসা এবং নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

বিক্ষোভকারীদের কর্মসূচি ও বার্তা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের জন্য আটটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে: হতাহতদের তালিকা তৈরি, হামলাকারীদের শনাক্ত, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য প্রশাসনের ওপর চাপ, আহতদের চিকিৎসা সহায়তা এবং নিহতদের কবর জিয়ারত ও পরিবারকে সমবেদনা।

আন্দোলনের অন্য একটি অংশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুক্রবার বাদ জুমা সারাদেশে মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনা ও শোক মিছিল করা হবে।

এছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সকল অপরাধীকে অপসারণ’ দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আইনি উদ্বেগ

বিএনপি আন্দোলনে হতাহতের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন, সহিংসতার প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “কারফিউ তুলে নেওয়া হোক এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের গণহারে গ্রেফতার না করা হোক।”

র‍্যাব এক বিবৃতিতে জানায়, আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি নয়, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে।

এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত, বিদেশি উদ্বেগ

২৫ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, আন্দোলনের কারণে ২৮, ২৯, ৩১ জুলাই এবং ১ আগস্টের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

প্রবাসে উদ্বেগ বাড়ছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের বিক্ষোভের তথ্য সংগ্রহে দূতাবাসগুলোকে চিঠি পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার জানান, ঢাকায় অবস্থানরত ‘জরুরি নয়’ এমন মার্কিন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।