মাশরাফির অবসর: যে কথা সবাই জানবে না

তার সময়ে যারা খেলা শুরু করেছিলেন, তাদের কেউ এখন আর নেই। জাতীয় দলে তো নয়ই, জাতীয় দলের আশপাশেও নেই। কিন্তু মাশরাফি এখনো আছেন। খেলে যাচ্ছেন ক্যারিয়ারের সেরা সময়ের মতোই। এর মধ্যেই হঠাৎ টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর ঘোষণা করে দিলেন তিনি। মাশরাফির এমন হঠাৎ অবসর মোটেই প্রত্যাশিত ছিলো না। আবার একদম অপ্রত্যাশিতও ছিলো না। কারণ দলের অভিভাবকই মাশরাফিকে চাচ্ছিলেন না। এমন কি দেশের বোর্ডও মুখ ফিরিয়ে নেয়া শুরু করেছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা অধিনায়কের দিক থেকে।

কিছুদিন আগে, বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ড সফরের সময়ই টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফিকে ছেঁটে ফেলার কথা চলছিলো। এর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ও চলছিলো মাশরাফির টি-টোয়েন্টি ছাড়ার গুঞ্জন। এবং শুনতে একটু আশ্চর্য লাগলেও, সত্য হলো, মাশরাফির অবসর নিয়ে কথাগুলো বেশির ভাগ সময়ই শুরু করেছেন চান্দিকা হাথুরুসিংহে; বাংলাদেশ দলের ‘অভিভাবক’।

চান্দিকা কিছুদিন আগেও বোর্ডকে বলেছেন যে, মাশরাফি আর টি-টোয়েন্টিতে চলেন না। এমন কি তামিম- মুশফিককেও টি-টোয়েন্টিতে অপছন্দ তার! বোর্ডও তোতা পাখির মতো চান্দিকার কথা ঢুকিয়ে দিয়েছে মাশরাফির কানে। মাশরাফিকে বলা হয়েছে, টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার নিয়ে ‘ভাবতে’।

কদিন আগেই মাশরাফি তার ঘনিষ্ট লোকদের কাছে বলেছেন যে, টি-টোয়েন্টিটা তিনি খেলে যেতে চান বর্তমান দলটাকে আরো শক্ত অবস্থানে নেয়ার জন্য। অন্তত মানসিকভাবে দলটাকে আরো পাকাপোক্ত করার স্বপ্ন ছিলো তার। সেই স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি যাকে বলে, মাশরাফি করেছেন সেটাই। যা হয়তো সাধারণ দর্শক পর্যায়ে জানা কথা নয়। কিন্তু মাশরাফির কাছের লোকজন খুব ভালো করেই জানেন, প্রতিটি ম্যাচে ফিট থাকার জন্য কী অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেন মাশরাফি।

শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়ার ঠিক আগেই টি-টোয়েন্টি দল নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা বলে গিয়েছিলেন মাশরাফি। কিন্তু আচমকাই তিনি বলেন— এই ফরম্যাটে আর থাকা হচ্ছে না তার। না, মাশরাফি ‘থাকা হচ্ছে না’ বলেননি। বলেছেন, তরুণদের সুযোগ দিতেই তিনি জায়গা ছাড়ছেন।

সপ্তাহ কয়েক আগেই যিনি যে দলকে নিয়ে স্বপ্নের পসরা সাজিয়েছেন, সেই তিনি হঠাৎ করেই কেনো চিন্তা বদলে ফেললেন? এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মাশরাফি তেমন কোনো কথা বলেননি। কেবল জানিয়েছেন, এখনই তার টি-টোয়েন্টি ছাড়ার সময়। নতুন অধিনায়ককে আগাম শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন মাশরাফি।

মাশরাফির অবসর নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখন পর্যন্ত নেই। এমন কি বিসিবি থেকে কোনো মেইল বা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টও প্রকাশ করা হয়নি। যেনো মাশরাফির টি-টোয়েন্টি ছাড়ার সিদ্ধান্ত বিসিবিকে একটা স্বস্তিই দিয়ে গেলো!

অবসরের পিছনের কারণগুলো সব সময়ই, প্রায় সবার ক্ষেত্রেই গোপন থাকে। মাশরাফির টি-টোয়েন্টি অবসরের পিছনের কারণও হয়তো কোনোদিন প্রকাশ পাবে না। কিন্তু কোচের কারণেই, কোচের একনায়কসূলভ চাহিদার কারণেই যে বোর্ড মাশরাফিকে ক্যারিয়ার নিয়ে ‘ভাবতে’ বলেছে, এটা নিশ্চিত তথ্য।

খেলোয়াড় হিসেবে মাশরাফি এখনো সেই পর্যায়ে যাননি, যে পর্যায়ে গেলে বাংলাদেশ দলে তার জায়গা হবে না। টি-টোয়েন্টিতে এখনো তর্কাতীতভাবে তিনি দলের সেরা বোলারদের একজন। কিন্তু বর্তমান মাশরাফিকে কখনোই শুধুমাত্র একজন বোলার বা একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে বিচার করা যায় না। আবেগে নয়, বরং যৌক্তিক কারণেই এই মাশরাফির গুরুত্ব অন্য কারণে বেশি।

সেই কারণ— নিঃসন্দেহে তার অধিনায়কত্ব। অধিনায়কের কাজ তো ম্যাচের নানা পরিবেশ- পরিস্থিতিতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। মাশরাফি কি শুধু তাই করতেন? তিনি তো আসলে নেতা। যার কাজ শুধু মাঠে সতীর্থদের অনুপ্রেরণা দেয়া বা ম্যাচ নিয়ে নানা সিদ্ধান্ত নেয়া নয়, বরং মাঠের বাইরেও সতীর্থদের সমস্যা- অসুবিধায় বড় ভাই বা পিতার রূপে আবির্ভূত হওয়া।

অধিনায়ক বা নেতা, অথবা দুই ভূমিকা; সবগুলো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাশরাফি এখনো বিকল্পহীন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই দুর্ভাগ্য; মাশরাফিকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী খেলতে দেয়া হলো না।

মাশরাফি নিজে হয়তো স্বীকার করবেন না এ কথা, কিন্তু বাতাসে কান পাতল তো শোনাই যায়; এই অবসর মাশরাফি স্বেচ্ছায় নেননি। তাকে অবসরে এক রকম বাধ্য করা হয়েছে। কিংবা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে পরিবেশ। যার কারণে আজন্ম লড়াকু মাশরাফি হারিয়ে ফেলেছেন লড়াইয়ের চিরায়ত প্রেরণা। চুপচাপ বলে দিয়েছেন- আমি আর থাকছি না। কিন্তু মাশরাফির অবসর ঠিক কী কারণে- সে কথা কেউ জানবে না।