গোপালগঞ্জ সহিংসতা: আসকের চোখে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রক্তক্ষয়ী সহিংসতাকে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। দুই দিনের সরেজমিন তদন্ত শেষে সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজনৈতিক সমাবেশে হামলা এবং পরবর্তী সময়ে নির্বিচার গ্রেপ্তার ও হয়রানির ঘটনা নাগরিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবার বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে এবং পুরো এলাকায় এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

গত ২১ ও ২২ জুলাই আসকের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গোপালগঞ্জ সফর করে। তারা সহিংসতার শিকার পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় প্রশাসন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

লাশ নিয়ে হয়রানি ও বিচার প্রক্রিয়ার শঙ্কা

আসকের প্রতিবেদনে সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে সহিংসতায় নিহত পাঁচ ব্যক্তির মরদেহ সৎকার প্রক্রিয়া নিয়ে। নিহতদের মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া রমজান মুন্সীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছিল, যার সুরতহাল প্রতিবেদনে গুলির চিহ্নের কথা উল্লেখ আছে।

অন্য চারজনের পরিবার অভিযোগ করেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর মরদেহ দ্রুত দাফন বা সৎকারের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। নিহত ইমন তালুকদারের পরিবার জানায়, তার শরীরে গুলির চিহ্নসহ একাধিক আঘাত থাকলেও ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ দাফনে বাধ্য করা হয়। পরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে, ঘটনার পাঁচ দিন পর ২১ জুলাই কবর থেকে তিনটি লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়। আসকের প্রতিনিধিদলের উপস্থিতিতেই রমজান কাজী ও ইমনের মরদেহ উত্তোলন করা হয়। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এই প্রক্রিয়াকে ‘নতুন এক ধরনের হয়রানি’ বলে মনে করছে এবং যথাযথ বিচার দাবি করেছে।

গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি

সংঘর্ষের পর গোপালগঞ্জে নেমে এসেছে ভয়ের পরিবেশ। আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ জুলাই রাত থেকে কারফিউ ও ১৪৪ ধারা জারির পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে আটক ও গ্রেপ্তার করেছে। এমনকি আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে। সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি এমন এলাকা থেকেও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তারের অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক নিরপরাধ মানুষ ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

২১ জুলাই পর্যন্ত এ ঘটনায় মোট আটটি মামলা দায়ের হয়েছে, যেখানে ৫ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫৮ জনের, যাদের মধ্যে ৩২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং ৩ জন নারী রয়েছেন। উদ্বেগজনকভাবে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১৮ জন শিশুকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে আসক, যাদের পরিবারের দাবি—সংঘর্ষের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

ঘটনার প্রেক্ষাপট ও প্রশাসনের বক্তব্য

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে আসক জানায়, ১৬ জুলাই এনসিপির সমাবেশের দিন সকাল থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। এনসিপি নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে ‘আক্রমণাত্মক মন্তব্য’ করার পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) আসকের প্রতিনিধিদলকে জানান, পুলিশ সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করেছে এবং কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি। হামলাকারীদের সড়ক অবরোধের চেষ্টা থেকে নিবৃত্ত করতে এবং এনসিপি নেতাদের নিরাপত্তা দিতেই তারা ব্যবস্থা নেন। নিরাপত্তার জন্য সেনা সাঁজোয়া যানও মোতায়েন করা হয়েছিল। ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৭৭ জনকে গ্রেপ্তারের কথা নিশ্চিত করেন তিনি।

তবে আসকের প্রতিনিধিদল গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছ থেকে অসহযোগিতামূলক আচরণ পেয়েছে এবং সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাক্ষাৎ করতে পারেনি।