২০২৪ সালের ২৯ জুলাই: রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান, লাল কাপড়ে রাস্তায় ছাত্র-জনতা

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালনের দিনকেই (১৯ জুলাই ২০২৪) সরকারবিরোধী প্রতীকে পরিণত করেছেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। লাল কাপড় চোখ ও মুখে বেঁধে ছবি তোলার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান তারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকারের খুদে বার্তায় কর্মসূচি ঘোষণার পর রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই লাল কাপড় কর্মসূচি। প্রোফাইল ছবি বদল করেন অসংখ্য তারকাও।

এদিকে, একই দিনে সরকারি ঘোষণায় নিহতদের স্মরণে দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে জানানো হয়, কালো ব্যাজ ধারণ, বিশেষ প্রার্থনা ও দোয়া মাহফিলের মাধ্যমে শোক পালন হবে।

কিন্তু আন্দোলনকারীরা এটিকে ‘নির্যাতনের বিচার না করে উপহাস’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের মতে, সরকার শহীদদের রক্তের সঠিক মূল্য দিচ্ছে না।

সারাদেশে বিক্ষোভ, দমন ও গ্রেপ্তার

২৯ জুলাই দিবাগত রাত থেকে রাজপথে ফের সক্রিয় হয় আন্দোলনকারীরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, কুমিল্লা, সিলেট, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।

ঢাকায় পল্টন, সেগুনবাগিচা, সায়েন্সল্যাব, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেক এলাকায় ধাওয়া ও লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে। পল্টনে কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়।

চট্টগ্রামে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। কুমিল্লায় আন্দোলনে যাওয়ার সময় এক শিক্ষার্থী পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কারফিউ-টহল-চেকপোস্ট, রাজপথে সেনা ও র‌্যাব

দশম দিনের মতো সারাদেশে কারফিউ অব্যাহত থাকে। যদিও দিনের বেলা শিথিলতা কিছুটা বাড়ানো হয়। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশের টহল চলে হেলিকপ্টার ও গাড়ি নিয়ে। বসানো হয় চেকপোস্ট, মাইকিং করে সতর্ক করা হয় যেন কেউ জমায়েত না হয়।

সমন্বয়কদের আটকের প্রতিক্রিয়া: হাইকোর্ট ও তীব্র নিন্দা

ডিবি কার্যালয়ে আটকে রাখা ছয় আন্দোলন সমন্বয়কের খাওয়ার ছবি প্রকাশ করে পুলিশ। এ নিয়ে হাইকোর্ট ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে আদালত বলে, “জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না।” আদালত সমন্বয়কদের মুক্তির নির্দেশ দিয়ে গুলি বন্ধেরও আহ্বান জানায়।

ডিবির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা ‘নিরাপত্তাহীনতায়’ ভুগছিলেন বলেই তাদের ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়।

জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন

আন্দোলনের সহিংসতা, গুলি, হত্যা, গুম, গ্রেপ্তারের তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহের জন্য শিক্ষক-আইনজীবীরা মিলে গঠন করেন ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’। এতে রয়েছেন সুলতানা কামাল, শাহদীন মালিক, গীতিআরা নাসরিনসহ ৮ সদস্য।

তারা জানান, ১ জুলাই থেকে চলমান আন্দোলনসংক্রান্ত যেকোনো তথ্য, ছবি, ভিডিও, সাক্ষ্য ই-মেইলের মাধ্যমে জমা দিতে অনুরোধ করা হবে।

শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের সমাবেশে ছাত্র হত্যার বিচার ও নয় দফা দাবির বাস্তবায়ন চাওয়া হয়। অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, “যাদের কাছে আমরা বিচার চাইছি, তারাই এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত।”

৭৪ বিশিষ্ট নাগরিক জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন।

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে ঐকমত্য

রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে ঐকমত্য গঠিত হয়। ওবায়দুল কাদের বলেন, “জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী অপশক্তিকে নির্মূল করা দরকার।”

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন সরকারকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

সমন্বয়ক আরিফ সোহেলের রিমান্ড

৩০ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর আন্দোলনের অন্যতম নেতা আরিফ সোহেলকে ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় সেতু ভবনে অগ্নিসংযোগ মামলায়। একই মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয় ব্র্যাকের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবকেও।