২০২৪ সালের ৩১ জুলাই: ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, আটক শতাধিক

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী হত্যা, গ্রেপ্তার, গুম ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ঘোষিত ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিকে ঘিরে ৩১ জুলাই ২০২৪, দেশজুড়ে তীব্র উত্তেজনা, বিক্ষোভ এবং পুলিশি বাধা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশি লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের ফলে সাংবাদিকসহ অন্তত ৯০ জন আহত হন এবং শতাধিক আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়।

ঢাকায় পুলিশি ধরপাকড়, শিক্ষকেরা রাস্তায়

৩১ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে হাইকোর্টের মাজার গেট এলাকায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমবেত হতে দেখা যায়। পুলিশ সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমানসহ শিক্ষকরা সরব উপস্থিতি জানান। হাইকোর্টের ভেতরে আইনজীবীদেরও মিছিল করতে দেখা যায়। বেলা একটার দিকে অন্য একটি দল মিছিল নিয়ে হাইকোর্টমুখী হলে পুলিশ বাধা দেয়, পরে তারা দোয়েল চত্বর ও শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মিছিলে অন্তত ১০-১৫ জন শিক্ষকও যোগ দেন। একইভাবে রাজশাহীতে আন্দোলন ঠেকাতে সকাল থেকেই আদালত চত্বরে পুলিশ-বিজিবি মোতায়েন ছিল। ক্যাম্পাসে সমর্থন জানিয়ে মিছিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম।

বরিশাল, সিলেট, গাজীপুরে সংঘর্ষ

বরিশালে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটায় চার সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। সিলেটে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গাজীপুরে শিক্ষার্থীদের মিছিলেও লাঠিপেটা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া: ‘আমার অপরাধটা কী?’

এই দিনই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের প্রসঙ্গে বলেন, “আমি জানি না, আমার অপরাধটা কী ছিল।”

তিনি অভিযোগ করেন, সহিংসতা ছড়িয়ে দেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই এ আন্দোলন চলছে। দেশব্যাপী সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কারা জড়িত, সে বিচারের ভারও তিনি জনগণের ওপর ছেড়ে দেন এবং বলেন, “আন্তর্জাতিক তদন্ত চাইলে আমরাও সহযোগিতা করব।”

আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

আন্দোলন দমনে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নিপীড়ন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক এক চিঠিতে নিরাপত্তা খাত সংস্কারের আহ্বান জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই সিনেটর বেন কার্ডিন ও কোরি বুকার বাংলাদেশের পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও চলমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে নির্ধারিত নতুন অংশীদারিত্ব আলোচনা স্থগিত করে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ

৩১ জুলাই বিকেলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে সরিয়ে ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগে বদলি করা হয়। তার স্থলে ডিবির দায়িত্ব পান আশরাফুজ্জামান।

চলমান পরিস্থিতিতে ফেসবুক, টিকটক ও হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, ভিপিএন ব্যবহারে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি থাকায় এ সিদ্ধান্ত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানান, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির সময় ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় আন্দোলন সমন্বয়ককে দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

ইউল্যাবের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, এই হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে। আন্তর্জাতিক তদন্ত ছাড়া এর বিশ্বাসযোগ্য সমাধান হবে না।

নতুন কর্মসূচির ঘোষণা: ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’

‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির পরদিন ১ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। কর্মসূচির নাম—‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’। এতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ভয়াবহ স্মৃতিচারণ, শহীদ ও আহতদের পরিবার-সহপাঠীদের অংশগ্রহণ, গ্রাফিতি, দেয়ালচিত্র, পোস্টার, ডিজিটাল আর্ট এবং সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকবে বলে জানানো হয়েছে।