২০২৪ সালের ২ আগস্ট: ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক, বিক্ষুব্ধ জনতার দখলে রাজপথ

২ আগস্ট ২০২৪, এই দিনে ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ এবং পরদিন ৪ আগস্ট থেকে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আন্দোলনে নিহত ও আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল।

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করল। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।

‘কোনো ট্যাক্স, কোনো বিল নয়’

২ আগস্ট আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ এক ফেইসবুক লাইভে বলেন, “৪ আগস্ট থেকে কেউ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বা কর পরিশোধ করবেন না। সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। গণভবন ও বঙ্গভবনের দিকে কোনো যানবাহন যেতে দেওয়া হবে না।”

মাহিন সরকার, আসিফ মাহমুদ সজীব, সারজিস আলম, নুসরাত তাবাসসুম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও আবু বকর মজুমদারসহ আন্দোলনের ছয় শীর্ষ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার একদিন পর এই ঘোষণা দেন। তারা অভিযোগ করেন, তাদের ডিবি হেফাজতে রেখে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বিবৃতি জোর করে আদায় করা হয়।

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা সে বিবৃতি স্বেচ্ছায় দিইনি। আমাদের পরিবারকে ১৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়, খাবার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও রেকর্ড করা হয়।”

রাজপথে ‘দ্রোহযাত্রা’: বিক্ষোভে জনতার ঢল

২ আগস্ট বিকেলে ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচিতে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত মিছিল করে হাজার হাজার মানুষ। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এতে অংশ নেয় শিক্ষক, শিল্পী, অভিভাবক, উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষার্থীরা।

বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “সরকার হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করুক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।”

মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা স্লোগান দেন: ‘রক্তের দাগ দিচ্ছে ডাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গুলিতে মরতে পারি, পিছু হটবো না’, ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’।

সহিংসতায় দুইজন নিহত, শতাধিক আহত

২ আগস্ট বিক্ষোভ চলাকালে হবিগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক মোশতাক মিয়া (২৫) নিহত হন। খুলনায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে কনস্টেবল শহিদুল ইসলাম মারা যান।

রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, টাঙ্গাইল, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে হেলমেটধারীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিতে গিয়ে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে।

ধানমন্ডিতে শিল্পীদের প্রতিবাদ, বনানীতে অভিভাবকদের অবস্থান

ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের সামনে ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’ ব্যানারে নাট্যকর্মী ও শিল্পীরা প্রতিবাদী পরিবেশনা করেন। শিল্পীদের দাবি ছিল—অত্যাচার, গুম, হত্যা ও কারফিউর নামে গণগ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার। বনানীতে অভিভাবকেরাও রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল: ‘আমার সন্তান গুলি খায়, আপনি হাসেন কেন?’

ইউনিসেফের উদ্বেগ: সহিংসতায় ৩২ শিশু নিহত

একই দিন ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক পরিচালক সঞ্জয় উইজেসেকেরা বলেন, “জুলাই মাসে আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৩২ শিশু নিহত হয়েছে। আরও অনেক শিশু আহত ও আটক হয়েছে। এটি একটি ভয়াবহ মানবিক সংকট।”

সরকারের অবস্থান: ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার অভিযোগ

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “কোটা সংষ্কারে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ সত্ত্বেও একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করছে। তারা সরকার ও শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফায়দা নিতে চায়।”

এক সপ্তাহে ১০ হাজার গ্রেপ্তার

১৬ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত চলা সহিংসতায় সরকার দেশজুড়ে চিরুনি অভিযান চালিয়ে ১০ হাজারের বেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে আছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ।

এদিন সহিংসতা-সংশ্লিষ্ট মামলায় জামিন পেয়েছেন ৭৮ এইচএসসি পরীক্ষার্থী।