২০২৪ সালের ৩ আগস্ট: দাবি এক, স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগ

ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ৩ আগস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে ৪ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ছাত্র-জনতা সরাসরি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৃহৎ আন্দোলনে প্রবেশ করে।

সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলাম বলেন, “সংলাপ নয়, স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগ চাই। আমাদের দাবি একটাই—শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ।” তিনি বলেন, ছাত্রদের হত্যার দায় নিয়ে শেখ হাসিনার বিচার হওয়া উচিত। পাশাপাশি তিনি সর্বস্তরের জনগণকে ‘ছাত্র-জনতার গণজাগরণে’ যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনার সংলাপ আহ্বান প্রত্যাখ্যান

এর আগে সকালেই শেখ হাসিনা পেশাজীবী পরিষদের সঙ্গে এক বৈঠকে আন্দোলনরতদের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব দেন। তবে সেই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের নেতারা দাবি করেন, বর্তমান সরকার ‘নিখাদ স্বৈরতন্ত্রে’ পরিণত হয়েছে।

১৫ দফা অসহযোগ কর্মসূচি

আন্দোলনের আরেক শীর্ষ নেতা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া একটি ১৫ দফা কর্মসূচির ঘোষণা দেন, যার মধ্যে রয়েছে—কর ও ইউটিলিটি বিল বন্ধ, অফিস আদালত বর্জন, বন্দর শ্রমিকদের কর্মবিরতি, বিদেশি রেমিট্যান্স বন্ধ, বাণিজ্যিক পরিবহন বন্ধ, আমলাদের সচিবালয়ে না যাওয়া, সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ইত্যাদি।

তিনি বলেন, “এটা গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছে।”

শহীদ মিনারে জনসমুদ্র, শাহবাগে অবরোধ

সকাল থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ জাতীয় পতাকা, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে রওনা হন। ‘দফা এক, দাবি এক—শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। সমাবেশ শেষে সন্ধ্যায় বিক্ষোভকারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে লাল কাপড় বেঁধে তারা প্রতিবাদের প্রতীক তৈরি করেন।

ঢাকাজুড়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ

বিক্ষোভকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে—যেমন রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে সড়ক অবরোধ করেন। মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের বিচারে দাবি জানিয়ে সমাবেশ করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও দিনভর তেমন বাধা দেওয়া হয়নি।

সাংবাদিকদের মিছিল, সেনাপ্রধানের বার্তা

সেদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কোটা আন্দোলনে নিহত চার সাংবাদিকের স্মরণে সাংবাদিক ইউনিয়নের দুটি সংগঠন সরকারের পদত্যাগ দাবি করে মিছিল করে। অপরদিকে, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনানিবাসে সেনাদের উদ্দেশে ভাষণে জনগণের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের গুজব থেকে সতর্ক থাকতে বলেন।

ঢাকার বাইরেও উত্তাল আন্দোলন

ঢাকার বাইরেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, যাত্রাবাড়ীতে ছাত্ররা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। ফরিদপুর, জামালপুর, কুমিল্লা ও সিলেটে সংঘর্ষ হয়। গাজীপুরে একজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত হন।

চট্টগ্রামে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাসায় হামলা হয় এবং গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় এমপি মহিউদ্দিন বাচ্চুর কার্যালয়েও হামলা চালানো হয়।

ইউনিসেফের উদ্বেগ, মার্কিন চিঠি

২ আগস্ট ইউনিসেফ জানায়, কোটাবিরোধী আন্দোলনে অন্তত ৩২ শিশু নিহত হয়েছে এবং অনেক শিশু আটক ও আহত হয়েছে। সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারকে শিশুদের আটক বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

এছাড়া ২২ জন মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে বলেন।

সরকারপক্ষের প্রতিক্রিয়া

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই আন্দোলন এখন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।”

একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “কোটা বাতিল সত্ত্বেও একটি স্বার্থান্বেষী মহল সরকারবিরোধী ফায়দা তুলছে।”