শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসানের পর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এক নতুন ধারার পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, পরিবর্তিত আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে সুযোগ ও সতর্কতা—উভয়কেই বিবেচনায় রেখে এই নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, যা দেশের বৈদেশিক সম্পর্কে এক নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ড.মুহাম্মদ ইউনূস

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক টমাস কিন সংবাদ সংস্থা আনাদোলুকে বলেন, ‘আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতিকে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছি’।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে ভারতের প্রতি অনুগত ছিল, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক উদ্বেগের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে শীতল করে তোলে। নয়াদিল্লির সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতার কারণে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা সীমিত ছিল।

কিন আরও যোগ করেন, ‘কিন্তু ভারত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভারতের চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে বাংলাদেশ উৎসাহিত হয়েছে।’

ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক ও উপ-পরিচালক লিন মিনওয়াং এই মতকে সমর্থন করে বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যের পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসা’।

তবে ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অ্যাডজাঙ্কট রিসার্চ ফেলো মুবাশার হাসান এটিকে বড় কোনো পরিবর্তনের চেয়ে ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, ‘চীনের দিকে অনেক বেশি ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, কিন্তু চীনারা হাসিনারও ঘনিষ্ঠ ছিল’। তিনি আরও বলেন, একমাত্র পরিবর্তনের ক্ষেত্র হলো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং হাসিনার সময়ের তুলনায় ঢাকার পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, যদিও তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়ন চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন।

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার

চলতি বছরের মার্চ মাসে ড. ইউনূস তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যান, যা ভারতের পরিবর্তে অন্য দেশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নতুন ধারার সূচনা করে। এই সফরে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ২.১ বিলিয়ন ডলারের (১.৮ বিলিয়ন ইউরো) চীনা বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান নিশ্চিত করেছেন বলে জানা গেছে।

টমাস কিন বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও চীন সম্পর্ক জোরদার করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে বেইজিং বুঝতে পারছে যে ঢাকায় একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না’। তার মতে, ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য ইচ্ছুক সব অংশীদারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো জশুয়া কুরলান্টজিক উল্লেখ করেন যে, যদিও হাসিনা বেইজিংয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, ‘ইউনূস বেইজিংয়ের সঙ্গে সেই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছেন’।

মুবাশার হাসানও বাংলাদেশে চীনের ‘দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের’ ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘চীন জানে যে বাংলাদেশের উন্নয়ন তহবিল প্রয়োজন এবং এখানে অবকাঠামো উন্নয়নের চাহিদা রয়েছে’। তাঁর মতে, বেইজিং এমন একটি অংশীদার, যার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি রয়েছে।

ভারতের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক

ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এখন নাটকীয় অবনতি ঘটেছে এবং বিশ্লেষকরা একমত যে সম্পর্কটি কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। টমাস কিন বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ উভয়কেই গঠনমূলকভাবে একসঙ্গে কাজ করার একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশে নির্বাচনের পর ভারত সম্পর্ক পুনর্গঠনের দিকে নজর দেবে এবং একটি নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে নতুন অধ্যায় শুরু করবে। এতে সম্পর্কটি হাসিনার সময়ের মতো ঘনিষ্ঠ না হলেও বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে’।

মুবাশার হাসান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের অতীতের কথিত ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের চোখে, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদে ভারত ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছিল’। তিনি যুক্তি দেন, ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈরিতা এড়িয়ে ভারতের সঙ্গে একটি ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছে।

লিন মিনওয়াং নতুন সরকারের এই নীতিকে ‘চীন ও ভারতের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা হাসিনার ‘ভারত-প্রথম’ কূটনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি হাসিনার নীতিকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর’ বলে অভিহিত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও কৌশলগত জোট

বিশেষজ্ঞদের মতে, ড. ইউনূসের অধীনে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। টমাস কিন বলেন, ‘স্পষ্টতই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনার চেয়ে ওয়াশিংটনের প্রতি বেশি অনুকূল মনোভাব পোষণ করে।’ তিনি এর কারণ হিসেবে ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের সমর্থন এবং যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ইউনূসের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক পণ্যের বাণিজ্য ১০.৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অধীনে অনিশ্চয়তার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

কিন বলেন, ‘তারা ‘মাত্র’ ২০% শুল্ক নিশ্চিত করতে পেরেছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সমান এবং ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর যে ২৫% শুল্ক আরোপ করেছে তার চেয়ে কম।’ তিনি আরও বলেন, এই ফলাফল ‘ঢাকায় একটি বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস’ নিয়ে এসেছে।

চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কৌশলগত জোটে যোগদানের জল্পনা থাকলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এর সপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। জশুয়া কুরলান্টজিক বলেন, ‘আমি মনে করি না বাংলাদেশ এই মুহূর্তে কোনো কৌশলগত জোট গঠন করতে যাচ্ছে। তাদের এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারই নেই, যারা এই ধরনের বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে’।

টমাস কিনও এতে একমত হয়ে বলেন, এই ধরনের জোট ভারতের জন্য একটি ‘চূড়ান্ত সীমা’ (রেড লাইন) অতিক্রম করবে। বরং তিনি বর্তমান পদক্ষেপগুলোকে ‘নয়াদিল্লির প্রতিকূল মনোভাবের’ প্রতিক্রিয়ায় একটি কৌশলগত ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। কিন আরও যোগ করেন, ‘ইউনূসের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো বাংলাদেশে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা, রাষ্ট্রকে সচল করা এবং একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করা।’

আনাদোলু এজেন্সি অবলম্বনে

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.