একগুঁয়েমি, ক্ষোভ আর শেষ ফোনকল: গণভবনের শেষ মুহূর্তের শ্বাসরুদ্ধকর নাটক

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ ছিলেন শেখ হাসিনা। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে যখন জানানো হচ্ছিল যে পরদিন ঢাকার রাজপথ লাখো মানুষের দখলে চলে যাবে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তখনও তিনি রক্তপাত ঘটিয়ে আন্দোলন দমনের পক্ষে ছিলেন। ৪ আগস্ট সারারাত তিনি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। কিন্তু গণভবনের ভেতরের দৃশ্য ছিল আরও নাটকীয়, যেখানে উত্তেজনা, মতবিরোধ এবং ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছিল।

এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত, তৎকালীন পুলিশ প্রধানের জবানবন্দি এবং গণভবনে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্রের কাছ থেকে।

শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব

পতনের আগের দিন, অর্থাৎ ৪ আগস্ট, গণভবন পরিণত হয়েছিল এক রুদ্ধদ্বার নাটকের মঞ্চে। তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জবানবন্দি অনুযায়ী, সেদিন একাধিক বৈঠক হয়। বেলা ১১টার বৈঠকে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটিকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তবে তার কথায়, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না।’

কিন্তু সবচেয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয় ৪ আগস্ট রাতের বৈঠকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেই বৈঠকে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক পদত্যাগের প্রসঙ্গ তুললে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শেখ হাসিনা। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ‘যা হওয়ার হবে, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না।’ এ সময় তিনি সেনাপ্রধানকে ‘মেরুদণ্ড শক্ত করে’ বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেন। তারিক সিদ্দিক তাতে সমর্থন দিয়ে বলেন, ‘সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোককে মেরে ফেললেই বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে।’ এমনকি তিনি হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর পরামর্শ দিলে বৈঠকে উপস্থিত বিমানবাহিনীর প্রধান তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এই লোকটি আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডোবাবে।’

অন্যদিকে, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী দুপুরে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দিলেও এর তীব্র বিরোধিতা করেন ওবায়দুল কাদের ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত। বরং সেই রাতে ‘গ্যাং অব ফোর’ হিসেবে পরিচিত ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক এবং সালমান এফ রহমান—সকলেই শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেন।

যে ফোনকলে বদলে গেল সব

৫ আগস্ট সকালেও পরিস্থিতি ছিল থমথমে। সামরিক কর্মকর্তারা গণভবনে এসে শেখ হাসিনাকে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পুনরায় পদত্যাগের অনুরোধ জানান। তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির কারণে লাখ লাখ জনতা গণভবনের দিকে এগিয়ে আসছে এবং সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন অনড়।

ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা কোনোভাবেই রাজি না হওয়ায় শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। তারা জয়কে জানান, তার মায়ের জীবন বাঁচাতে হলে পদত্যাগের আর কোনো বিকল্প নেই এবং সিদ্ধান্তটি এখনই নিতে হবে। পরিস্থিতি অনুধাবন করে জয় তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন এবং তার কথায়ই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন শেখ হাসিনা।

পলায়ন

পদত্যাগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় দেওয়া হয় গোছানোর জন্য। পূর্বের কিছু সংবাদে বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা বলা হলেও পরবর্তী সময়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা কঠোর নিরাপত্তায় গাড়িতে করে গণভবন থেকে নিকটস্থ বাণিজ্য মেলার মাঠে যান। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে তাদের কুর্মিটোলার বিমানবাহিনীর বঙ্গবন্ধু এয়ারবেইসে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর বিমানবাহিনীর একটি সি-১৩০ পরিবহন বিমানে করে তারা ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। ৫ আগস্ট, ভারতীয় সময় বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে বিমানটি নয়াদিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সেখানে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান বলে দেশটির গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকে তার একাধিক অডিও বার্তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।