জাতীয় পার্টিতে ফের ভাঙন: জিএম কাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি, ‘ভুলের জন্য ক্ষমা’ প্রার্থনা

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বারবার ভাঙনের শিকার হওয়া জাতীয় পার্টিতে আরও একবার ভাঙন স্পষ্ট হলো। দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও তার অনুসারীদের বাদ দিয়ে শনিবার ঢাকায় এক কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করেছে দলটির একটি অংশ। এই কাউন্সিলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে চেয়ারম্যান এবং এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব নির্বাচিত করা হয়েছে।

শুধু নতুন কমিটি গঠনই নয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণকে ‘রাজনৈতিক ভুল’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে দেশবাসীর কাছে ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ চেয়েছে এই অংশটি।

রাজনীতিতে টিকে থাকার কৌশল?

নতুন কমিটির নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া মো. মুজিবুল হক চুন্নু এই ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করতে গিয়ে হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত সব সময় নেওয়া যায় না। আমরা বিগত অনেকগুলো নির্বাচন করেছি... যদি নৈতিকভাবে ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেই জন্য আজকের দিনে এই কাউন্সিলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’

বিশ্লেষকদের মতে, গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারের একটি কৌশল হিসেবেই এই ক্ষমা প্রার্থনার পথ বেছে নিয়েছে জাতীয় পার্টির নতুন অংশ। মুজিবুল হক চুন্নু বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেছেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, বড় দুইটি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নানান কারণে তারা যে অবস্থায় রয়েছে, তাদের পক্ষে এখন ঘুরে দাঁড়ানো অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই বিএনপির সঙ্গে প্যারালাল আরেকটা রাজনৈতিক দল হওয়া উচিত। সেই চিন্তা থেকে আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছি।’

এই লক্ষ্যেই অতীতে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়া বিভিন্ন অংশকে একীভূত করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।

‘আমরাই মূল জাতীয় পার্টি’

নতুন কমিটি ঘোষণার পর মুজিবুল হক চুন্নু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজেদেরকে ‘মূল জাতীয় পার্টি’ হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আমরাই মূল জাতীয় পার্টি, লাঙ্গলও আমাদের। জিএম কাদের ও শামীম হায়দার পাটোয়ারির জাতীয় পার্টির আর কোনো অস্তিত্ব নাই।’

এই নতুন কমিটিতে কাজী ফিরোজ রশিদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এবং মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে নির্বাহী চেয়ারম্যান করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম জহির এই নামগুলো ঘোষণা করেন এবং জানান, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে।

জিএম কাদের অংশের প্রতিক্রিয়া

যদিও এই কাউন্সিল নিয়ে জিএম কাদের বা তার অংশের মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর তাৎক্ষণিক কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, তবে বিকেলে এক অনুষ্ঠানে শামীম হায়দার পাটোয়ারী পরোক্ষভাবে এর জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস বলে, মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে যারা জাতীয় পার্টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছেন, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়েছেন।’ তার কথায় স্পষ্ট যে, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে থাকা অংশই নিজেদের ‘মূল স্রোত’ বলে মনে করে।

যেভাবে ভাঙনের প্রেক্ষাপট তৈরি হলো

এই বিভক্তির বীজ রোপিত হয়েছিল আগেই। গত ২৮ জুন জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশ জাতীয় সম্মেলনের ডাক দিলেও পরে তা স্থগিত করে। কিন্তু আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের অনুসারীরা সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

এরই মধ্যে গত ৭ জুলাই জিএম কাদের এক ঘোষণায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক চুন্নুসহ দশ নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা আদালতের শরণাপন্ন হলে গত ৩১ জুলাই আদালত জিএম কাদেরের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আদালতের এই নিষেধাজ্ঞার পরই আনিসুল-চুন্নু অংশটি শনিবারের এই জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করে।