পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের নতুন দিগন্ত, টি-শার্ট রপ্তানিতে নতুন ইতিহাস

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টি-শার্ট রপ্তানিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও চীনের মতো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটি। এই সাফল্য দেশের তৈরি পোশাক খাতে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে, যার পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে মার্কিন প্রশাসনের আরোপিত পাল্টা শুল্ক।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের (ইউএসআইটিসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশটি বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৩৫২ কোটি ডলারের টি-শার্ট আমদানি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ একাই রপ্তানি করেছে ৩৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পণ্য। এর মধ্য দিয়ে ৩৬ বছরের ইতিহাসে হন্ডুরাস, মেক্সিকো, জ্যামাইকা, চীন ও হংকংয়ের মতো দেশগুলোর আধিপত্যের অবসান ঘটল।

এই পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন শুল্কনীতির নাটকীয় পরিবর্তন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করলেও চীনের ওপর ৩০ শতাংশ এবং ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক নির্ধারণ করেন। ফলে মার্কিন ক্রেতারা তুলনামূলক সাশ্রয়ী হওয়ায় বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন। আগে যেসব দেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত, যেমন নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাস, তাদেরও এখন ন্যূনতম ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অন্যদের চেয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে।

এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশি কারখানাগুলো বিপুল পরিমাণ নতুন ক্রয়াদেশ পেতে শুরু করেছে। শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলেন, ‘এক মার্কিন ক্রেতা গত বছর ৭ লাইনে উৎপাদিত জ্যাকেটের কাজ এ বছর ১৭ লাইনে নিতে চাচ্ছেন। আরেক ক্রেতা ২০ লাইনের উৎপাদন সক্ষমতা আরও ১০-১৫ লাইন বাড়াতে চাইছেন।’

একইভাবে স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্মের জন্য আমরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি ক্রয়াদেশ পেয়েছি। ভারত ও চীন থেকে আসা এই বাড়তি চাপ সামলাতে আমরা অতিরিক্ত ওভারটাইমের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

শুধু ক্রয়াদেশই নয়, বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে। চীনা বিনিয়োগকারীরা এখন বাংলাদেশকে নতুন উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে দেখছেন। চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে হান্ডা (বাংলাদেশ) গার্মেন্টস কোম্পানি এবং খাইশি গ্রুপ প্রায় ৪ কোটি ডলার করে বিনিয়োগে নতুন কারখানা স্থাপন করছে। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) জানিয়েছে, গত আট মাসে ৩৪টি চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, যার মোট পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি ডলার। বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, ‘চীনা বিনিয়োগকারীরা শুধু অর্থই আনবে না, সঙ্গে নতুন ক্রেতাও নিয়ে আসবে, যা আমাদের শিল্পের জন্য ইতিবাচক।’

রপ্তানি খাতের এই সাফল্যের সুফল ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও। দীর্ঘ ২২ বছর বন্ধ থাকার পর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উদ্যোগে রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র রাজশাহী টেক্সটাইল লিমিটেড’ পুনরায় চালু হয়েছে। শতভাগ রপ্তানিমুখী এই কারখানায় এরই মধ্যে প্রায় দুই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্প স্থাপন করে স্থানীয় মানুষের হাতে চাকরির সুযোগ পৌঁছে দিতে চাই।’

তবে এই সম্ভাবনার আড়ালে গভীর সংকটও রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকট, উচ্চ সুদের হার এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে ৩৫৩টি মাঝারি ও ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। শিল্পে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় উৎপাদন খরচ ৮ থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সুবর্ণ সুযোগকে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যে রূপান্তর করতে হলে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাংকিং প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং শুল্ক সংক্রান্ত জটিলতা দূর করা জরুরি। যদি অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যায়, তবে ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সঠিক নীতি ও পরিকল্পনাই হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মূল চাবিকাঠি।