তীব্র গরমে বিপর্যস্ত ইউরোপের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
তীব্র দাবদাহে পুড়ছে ইউরোপ। উষ্ণায়নের প্রভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে পারমাণবিক শক্তির কথা বলা হলেও, এখন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই তীব্র গরমের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

নিউক্লিয়ার কনসাল্টিং গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক পল ডরফম্যান আনাদোলুকে বলেন, ‘পারমাণবিক শক্তিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রচার করা হলেও বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। দুর্ভাগ্যবশত, পারমাণবিক শক্তিই হবে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় এবং প্রাথমিক শিকার।’
এ বছর ইউরোপের বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এর কারণ কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়, বরং চুল্লি শীতল রাখার জন্য ব্যবহৃত নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত গরম হয়ে ওঠা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফ্রান্স, যেখানে দেশের মোট বিদ্যুতের প্রায় ৬৫ শতাংশ পারমাণবিক উৎস থেকে আসে। এই গ্রীষ্মে দেশটির ১৮টি পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রায় সবকটিতেই উৎপাদন কমাতে হয়েছে।
শীতলীকরণের সংকট: উত্তপ্ত নদী, অচল চুল্লি
ইউরোপে প্রায় ১৬৬টি সচল পারমাণবিক চুল্লি রয়েছে, যেগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৪৯ গিগাওয়াট, যা বিশ্বের মোট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে ফ্রান্সে সর্বোচ্চ ৫৭টি এবং যুক্তরাজ্যে ৯টি চুল্লি রয়েছে। এ ছাড়া স্পেন, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং বেলজিয়ামেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে।
দশক আগে নির্মিত এসব কেন্দ্র জলবায়ু সহনশীলতার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত চুল্লিগুলোকে ঠান্ডা রাখতে এসব কেন্দ্র মূলত নিকটবর্তী নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। চুল্লি থেকে তাপ শোষণের পর এই পানি সাধারণত পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নদীর পানির স্তর কমে গেলে বা তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে শীতলীকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যা পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
পল ডরফম্যান বলেন, ‘অতিরিক্ত গরম পানি নদীতে ফিরিয়ে দেওয়া হলে তা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয়। এ কারণে নিয়ন্ত্রক তাপমাত্রা সীমা নির্ধারণ করা আছে, যা ফ্রান্স ইতোমধ্যে লঙ্ঘন করেছে।’ তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, ফ্রান্সের রোন এবং লোয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া এবং উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চুল্লিগুলো ইতোমধ্যেই সংকটে পড়েছে।
ফ্রান্স সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই গ্রীষ্মে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে একই চিত্র দেখা গেছে। সুইজারল্যান্ডের বেজনাউ বিদ্যুৎকেন্দ্রে আরে নদীর ওপর নির্ভরশীল একটি চুল্লি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং অন্যটির উৎপাদন ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। মধ্য ইউরোপের দেশ চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়ার মতো দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোও একই ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ইউরোপের ঝুঁকি বেশি
ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থার মতে, ইউরোপ বিশ্বের দ্রুততম উষ্ণায়নশীল মহাদেশ, যেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বিশ্বের গড় হারের প্রায় দ্বিগুণ। আগামী দশকগুলোতে ইউরোপে চরম তাপপ্রবাহের ঘটনা আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া দপ্তর সম্প্রতি জানিয়েছে, তীব্র গরমের পাশাপাশি খরা, আকস্মিক বন্যা এবং ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠছে।
পল ডরফম্যান সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা জানি আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে কী ঘটতে চলেছে। অভ্যন্তরীণ নদীগুলো সংকটে পড়বে, এটা নিশ্চিত। এমনকি উপকূলীয় কেন্দ্রগুলোও জলবায়ুর এই অস্থিরতা থেকে নিরাপদ নয়।’ তিনি যোগ করেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এটি কোনো জল্পনা নয়, এটি ইতোমধ্যেই ঘটছে।’
চাহিদা যখন তুঙ্গে, উৎপাদন তখন তলানিতে
তীব্র গরমের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা আকাশচুম্বী হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যখন বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ঠিক তখনই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায়।
জ্বালানি বিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘এম্বার’-এর এক নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন-জুলাই মাসের তাপপ্রবাহে স্পেনে বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ শতাংশ, ফ্রান্সে ৯ শতাংশ এবং জার্মানিতে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এম্বার-এর ইউরোপ প্রোগ্রামের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালক পাওয়েল সিজাক আনাদোলুকে বলেন, ‘যেকোনো তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র তার শীতলীকরণ ব্যবস্থার জন্য হ্রদ, নদী বা সমুদ্র থেকে পানি গ্রহণ করে। কিন্তু নদীর পানি আগে থেকেই গরম থাকলে শীতলীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এর ফলে পারমাণবিক উৎপাদন কমাতে হয়।’ তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, ফ্রান্স বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কারণ দেশটি বিদ্যুতের জন্য মূলত পারমাণবিকের ওপর নির্ভরশীল।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝোঁক
এই সংকটের মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এম্বার-এর তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২২ শতাংশ এসেছে সৌরশক্তি থেকে, যা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে ছাড়িয়ে গেছে।
পল ডরফম্যান বলেন, ‘গত বছর বিশ্বব্যাপী নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৯৪.২ শতাংশই ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি। একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে ১৩ থেকে ১৭ বছর সময় লাগে, যা আমাদের জলবায়ু সংকটের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক দেরিতে।’ তিনি মনে করেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ব্যাটারি সংরক্ষণের মতো গ্রিড উদ্ভাবন একটি আরও সহনশীল বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।
পাওয়েল সিজাক যোগ করেন, তাপপ্রবাহের সময় সৌর বিদ্যুৎ একটি শক্তিশালী সহযোগী হিসেবে কাজ করে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি বছরই আরও বেশি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন দেখতে পাচ্ছি।’ তবে তিনি স্বীকার করেন যে এই পরিবর্তন রাতারাতি ঘটবে না। তার মতে, আগামী পাঁচ বছর কিছুটা কঠিন হতে পারে, তবে এরপর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.