কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরতা: চিকিৎসকদের দক্ষতা কমছে, গবেষণায় উদ্বেগ

স্বাস্থ্যখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে, তবে এর কিছু ঝুঁকিও থাকতে পারে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ইউরোপীয় গবেষকদের পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোলোনোস্কোপি করার সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা চিকিৎসকদের নিজস্ব টিউমার শনাক্ত করার ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।

গবেষণাটি পোল্যান্ডের চারটি এন্ডোস্কোপি কেন্দ্রে ‘অ্যাকসেপ্ট’ নামক একটি পরীক্ষার অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়, যেখানে ২০২১ সালের শেষের দিকে পলিপ শনাক্তকরণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালু করা হয়েছিল। সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত ১,৪৪৩ জন রোগীর ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা ছাড়া কোলোনোস্কোপি করা হয় এবং এর ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হয়।

গবেষণায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের আগের তিন মাস এবং পরের তিন মাসে টিউমার শনাক্তকরণের হার তুলনা করা হয়। ফলাফলে দেখা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংস্পর্শে আসার পর চিকিৎসকদের টিউমার শনাক্তকরণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। আগে এই হার ছিল ২৮.৪ শতাংশ, যা পরে ২২.৪ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ, শনাক্তকরণের হার প্রায় ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গবেষণাপত্রটি বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ল্যানসেট গ্যাসট্রোএন্টেরোলজি অ্যান্ড হেপাটোলজি’-তে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকদের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমাগত ব্যবহার চিকিৎসকদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছাড়া কোলোনোস্কোপি করার সময় তাদের টিউমার শনাক্তকরণের হার কমে যাচ্ছে। রোগীর লিঙ্গ এবং বয়সও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বলে তারা উল্লেখ করেন।

এই গবেষণার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস-ভিত্তিক জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ ড. হার্ভে ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘এই গবেষণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।’ ফক্স নিউজ ডিজিটালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সমীক্ষাটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য তুলে ধরেছে: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের ক্যানসার শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে যখন এই প্রযুক্তি হাতের কাছে থাকে না, তখন চিকিৎসকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দুর্বল করে দিতে পারে।’

ড. ক্যাস্ট্রো আরও বলেন, শনাক্তকরণের হারে মাত্র ১ শতাংশ পরিবর্তনও হাজার হাজার রোগীর কোলন ক্যানসার থেকে বেঁচে ফেরার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ৬ শতাংশ হ্রাস পাওয়াকে তিনি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন।

তবে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পুরোপুরি বর্জন না করে এর বিচক্ষণ ব্যবহারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, রোগ শনাক্তকরণ এবং জীবন বাঁচানোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের হাতে থাকা অন্যতম শক্তিশালী একটি হাতিয়ার।’

তার মতে, ‘এই গবেষণা আমাদের একটি সহজ সত্য মনে করিয়ে দেয়: চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও একটি মানবিক পেশা। চিকিৎসকের চোখ, বিচারবুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা অপরিবর্তনীয়।’

ড. ক্যাস্ট্রো মনে করেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সঠিক পথ হলো ভারসাম্য রক্ষা করা। প্রযুক্তি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যা চিকিৎসকদের দুর্বল করার পরিবর্তে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। এর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ, তত্ত্বাবধান এবং উদ্দেশ্যমূলক নকশা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।