বাংলাদেশ-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা: ভারতের উদ্বেগ বাড়ছে কেন?

চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বার্থের মধ্যে এক ধরনের ‘অভিন্নতা’ দেখা যাচ্ছে, যা ভারতের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। সম্প্রতি ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহানের এই মন্তব্য দিল্লির নীতি নির্ধারকদের গভীর উদ্বেগেরই প্রতিফলন। এই উদ্বেগের মূলে রয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত বাড়তে থাকা কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক ঘনিষ্ঠতা, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ নতুন করে সাজাতে শুরু করেছে।

কয়েক মাস আগেও যা ছিল অকল্পনীয়, তাই এখন বাস্তব। দীর্ঘ বিরতির পর পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য চালুর পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা এবং ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালুর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তান। দেশ দুটির সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সফর বিনিময়ও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

সাম্প্রতিক এই ঘটনাপ্রবাহ ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। তাদের আশঙ্কা, এই সম্পর্ক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আবারও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সাবেক শীর্ষ কূটনীতিক ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিক্রি এই পরিস্থিতিকে ‘ডেজাঁ ভু’ বা ‘পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি’ হিসেবে দেখছেন। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, তখন বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো তৎপরতা চালাত। ২০০৪ সালের দশ ট্রাক অস্ত্র চালানের ঘটনাও সে সময়েই ঘটেছিল। শেখ হাসিনা সরকারের কঠোর নীতির কারণে গত এক দশকে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও, নতুন বাস্তবতায় সেই স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে দিল্লি।

ঢাকা ও ইসলামাবাদের এই নৈকট্যকে কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হিসেবে দেখছে না ভারত। মাসছয়েক আগে মাস্কাটে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্সে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন আঞ্চলিক জোট ‘সার্ক’কে পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দিলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ভারত মনে করে, সার্ককে সক্রিয় করার কথা বলা প্রকারান্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া, কারণ পাকিস্তানের কারণেই জোটটি প্রায় এক দশক ধরে অচল হয়ে আছে। এমনকি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সে সময় বাংলাদেশকে ‘সন্ত্রাসবাদকে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে না ধরার’ জন্যেও সতর্ক করেছিলেন।

বিশ্লেষকরা এই নতুন মেরুকরণের পেছনে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক খেলার আভাস পাচ্ছেন। লন্ডন-ভিত্তিক বিশ্লেষক প্রিয়জিৎ দেবসরকারের মতে, এর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির সম্পর্ক থাকতে পারে। তিনি মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে এই অঞ্চলের একমাত্র প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে না দেখে, ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এক কাতারে এনে একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে চাইছে। ওয়াশিংটনের এই কৌশলের কারণেই ঢাকা ও ইসলামাবাদ কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে বলে তার ধারণা।

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশহাক দারের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর দিল্লির উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। সফরে তিনি কেবল সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গেই বৈঠক করেননি, বিএনপি ও জামায়াতের মতো দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি একাত্তরের গণহত্যাকে ‘মীমাংসিত বিষয়’ বলে মন্তব্য করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান, যা দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অধ্যায়কে লঘু করে দেখার চেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ভারতের জন্য এটি কেবল সামরিক বা নিরাপত্তার বিষয় নয়, এর একটি আদর্শিক দিকও রয়েছে। বিশ্লেষক শান্তনু মুখার্জির মতে, পাকিস্তান বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে সে দেশের ভাবধারায় দীক্ষিত করতে চাইছে, যা ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাবের পরিপন্থী। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের এই ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে বলে দিল্লিতে একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে, যা দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে নতুন করে কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

বিবিসি অবলম্বনে