বেছে বেছে শোনা ইচ্ছাকৃত নয়, নেপথ্যে ‘মস্তিষ্কের জটিল কার্যকলাপ’

অনেকেই হয়তো মনে করেন, আপনার জীবনসঙ্গীর ‘বেছে বেছে শোনার’ প্রবণতাটি ইচ্ছাকৃত। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। এর পেছনে রয়েছে মস্তিষ্কের জটিল কার্যকলাপ।

নিউইয়র্কের অডিওলজি আইল্যান্ডের ড. স্টেলা ফুলম্যান তার এক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বেছে বেছে শোনা আসলে অন্যান্য শব্দের চেয়ে নির্দিষ্ট কোনো শ্রবণ উদ্দীপনাকে মস্তিষ্কের প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষমতা। এটি ব্যক্তিকে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশেও নির্দিষ্ট শব্দের ওপর মনোযোগ দিতে সাহায্য করে এবং অপ্রয়োজনীয় শব্দগুলোকে উপেক্ষা করে।’ তার মতে, এই প্রক্রিয়াটি প্রায়শই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে, যা আমাদের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশেও প্রাসঙ্গিক তথ্যের ওপর মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি বিচে অবস্থিত হিয়ারইউএসএ প্রতিষ্ঠানের শ্রবণ বিশেষজ্ঞ হোর্হে রে জানিয়েছেন, বেছে বেছে শোনার বিষয়টি কেবল কাউকে এড়িয়ে যাওয়া বা উপেক্ষা করার ব্যাপার নয়। এটি মূলত একটি স্নায়বিক প্রক্রিয়া, যা আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে শব্দ প্রক্রিয়া করে তার সঙ্গে সম্পর্কিত।

বৈজ্ঞানিকভাবে এই প্রক্রিয়াকে ‘অডিটরি সিলেক্টিভ অ্যাটেনশন’ বা শ্রবণ মনোযোগের ঐচ্ছিক প্রক্রিয়া বলা হয়। এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক একটি ছাঁকনির মতো কাজ করে, যা কোলাহলের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা অর্থপূর্ণ কথাকে আলাদা করে নেয়। হোর্হে রে বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বেছে বেছে শোনা কোনো অমনোযোগ বা অনাগ্রহের ফল নয়। এটি মূলত মস্তিষ্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ এবং ক্লান্তির কারণে ঘটে।’ অর্থাৎ, কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে কাজ চালিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই মস্তিষ্ক কিছু শব্দকে অন্যগুলোর চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়।

এর একটি পরিচিত উদাহরণ হলো, কোলাহলপূর্ণ রেস্তোরাঁর মধ্যে বন্ধুর কণ্ঠস্বর শুনে নেওয়া, যা ‘ককটেল পার্টি এফেক্ট’ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়াটি মস্তিষ্কের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। একটি হলো ‘অডিটরি কর্টেক্স’, যা শব্দ প্রক্রিয়া করে এবং অন্যটি হলো ‘প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স’, যা মনোযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

তবে হোর্হে রে সতর্ক করে বলেন, বেছে বেছে শোনার এই প্রবণতা যদি দৈনন্দিন জীবন বা সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে, তবে তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রবণশক্তি কমে গেলে এই প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হতে পারে। তখন সব শব্দই মনোযোগের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। এর ফলে ‘শ্রবণজনিত ক্লান্তি’ দেখা দেয়, যা মস্তিষ্কের জন্য শব্দ প্রক্রিয়াকরণ আরও কঠিন করে তোলে। দীর্ঘদিন ধরে শ্রবণশক্তি হ্রাসের চিকিৎসা না করালে তা স্মৃতিশক্তি এবং জ্ঞানীয় স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

শ্রবণশক্তি হ্রাসের কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে – কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন বুঝতে অসুবিধা হওয়া, বারবার অন্যকে কথা পুনরাবৃত্তি করতে বলা, কথা শোনার জন্য বক্তার দিকে ঝুঁকে পড়া এবং মাঝে মাঝে অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দেওয়া। এছাড়া, কথা শোনার সময় বিরক্ত, ক্লান্ত বা হতাশ বোধ করাও এর লক্ষণ হতে পারে।

হোর্হে রে পরামর্শ দেন, যদি এই সমস্যাগুলো ঘন ঘন দেখা যায় এবং আশেপাশের মানুষও বিষয়টি লক্ষ্য করে, তবে একজন শ্রবণ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। আধুনিক শ্রবণযন্ত্রগুলো শুধু শব্দ শোনাতেই সাহায্য করে না, বরং পারিপার্শ্বিক কোলাহল কমিয়ে নির্দিষ্ট কথায় মনোযোগ দিতেও সহায়তা করে।