উত্তরাঞ্চলে কিশোরী ক্লাব বদলে দিচ্ছে বাস্তবতা; ঠেকানো যাচ্ছে বাল্যবিয়ে

উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে কিশোরীদের জীবনে নীরব বিপ্লব ঘটছে। স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা এখন শুধু পড়াশোনা নয়, নিজেদের ভবিষ্যৎ বাঁচাতেও লড়ছে সংগঠিতভাবে বাল্যবিয়ে ঠেকাতে। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিভিন্ন গ্রামের কিশোরী ক্লাবগুলো।

কুড়িগ্রামের পঞ্চগাছি ইউনিয়নের নবনীপাড়ার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জ্যোতিকা রানী যখন জানতে পারে, তার বাল্যবিয়ে ঠিক করা হয়েছে, তখন সে গ্রামের প্রচলিত নীরবতার পথ অনুসরণ করেনি। সে ছুটে যায় তার কিশোরী ক্লাবে।

‘আমি পড়তে চাই,’ জ্যোতিকার এমন অনুরোধের পর ক্লাবের সদস্যরা তার বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে বোঝান। শেষ পর্যন্ত বিয়ে বন্ধ হয়।

এ ঘটনা একা নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুমি আখতারের বিয়েও ছিল মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে। সে খবর দেয় তার শিক্ষিকাকে, যিনি দ্রুত পরিবারকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন।

‘এখন আমার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া,’ বলেন সুমি।

এই পরিবর্তন এসেছে ইউনিসেফ সমর্থিত এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ পরিচালিত স্ট্রেংদেনিং সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ার চেঞ্জ (এসএসবিসি) প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে ওঠা কিশোরী ক্লাবগুলোর সক্রিয় ভূমিকার ফলে।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবি চন্দ্র বলেন, গ্রামে কোথাও বাল্যবিয়ে বা নির্যাতনের ঘটনা দেখলেই আমরা ১০৯৮ বা ৯৯৯ নম্বরে কল দিই। যদি সেটা সম্ভব না হয়, ক্লাবকে জানাই। কাউকে যেন নীরবে কষ্ট পেতে না হয় সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

প্রকল্পের প্রথম চার বছরে ৪ লাখ ৫৯ হাজারের বেশি মানুষ এ উদ্যোগের আওতায় এসেছে এবং ২৪৪টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা গেছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১১৯টি, কুড়িগ্রামে ১২৫টি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ চারটি উপজেলায় চলছে।

বাংলাদেশ এখনো বিশ্বে বাল্যবিয়ের উচ্চহারযুক্ত দেশের একটি। দেশে অর্ধেকেরও বেশি মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই হার ৭২.৯% এবং কুড়িগ্রামও রয়েছে বাল্যবিয়ের শীর্ষ জেলাগুলোর মধ্যে।

দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, সামাজিক চাপ এই সবকিছুর মাঝেই প্রকল্পটি কাজ করছে পরিবার ও সমাজকে সচেতন করে তুলতে।

টিবিএস এর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি মাঠপর্যায়ে গিয়ে দেখেন, গ্রামগঞ্জের উঠানে গোল হয়ে বসে মেয়েরা আলোচনা করছে কীভাবে আগে থেকেই বাল্যবিয়ে ঠেকানো যায়।

এই ক্লাবগুলোতে নিয়মিত মাসিক স্বাস্থ্যবিধি, পুষ্টি, বাল্যবিয়ের ঝুঁকি, মাতৃমৃত্যুর কারণ এবং কিশোরী মায়ের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ক্ষতি এসব বিষয় নিয়ে সেশন।

প্রতি মাসে সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজও নেন কোনো ঝুঁকিতে আছে কি না কোনো মেয়ে।

জ্যোতিকার মা জয়ন্তী রানী বলেন, আগে আমরা গরিব ছিলাম, এসব বুঝতাম না। এখন জানি, বাল্যবিয়ে কত বিপদ। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভালো হোক, সেটাই চাই।

প্রকল্পের অংশ হিসেবে স্থানীয় ইমাম, পুরোহিত ও কমিউনিটি নেতাদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

কুড়িগ্রামের স্থানীয় ইমাম আবদুল কাইয়ুম সিরাজী বলেন, মাসে একবার খুতবায় বলি, বাল্যবিয়ে আইনেও নিষিদ্ধ, নৈতিকভাবেও ভুল। ধর্ম নিষ্পাপদের সুরক্ষার কথা বলে, ক্ষতির নয়।

এ পর্যন্ত দুই জেলায় প্রায় ৬৪০ জন ধর্মীয় নেতা এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন।

কুড়িগ্রামের জাট্রাপুর গার্লস হাইস্কুলে গড়ে তোলা হয়েছে ‘পিয়ার এডুকেটর গ্রুপ’। প্রতিটি শ্রেণি থেকে ছয়জন শিক্ষার্থী ঝুঁকিতে থাকা সহপাঠীদের খুঁজে বের করে শিক্ষককে জানায়।

ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান জানান, এখন পুলিশ, মোবাইল কোর্ট ও স্থানীয় কমিটির সমন্বয়ে বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমেছে।
অনেক পরিবার এখনও লুকিয়ে বিয়ে দিতে চায় নৌকায়, অটোরিকশায়। তাই আমরা কাজীসাহেবদের বলেছি বয়স যাচাই ছাড়া যেন কেউ বিয়ে না পড়ান, বলেন তিনি।

প্রকল্প ব্যবস্থাপক আজিজুল হক বলেন, আমরা উঠান বৈঠকের মাধ্যমে তথ্য দিচ্ছি। মানুষ এখন ২০১৭ সালের বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, সরকারি হটলাইন সব জানে। তারা এখন অধিকার রক্ষায় নিজেরাই আওয়াজ তুলছে।

বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় রয়েছে- ৫১টি পিয়ার এডুকেটর গ্রুপ, ৫৩টি চাইল্ড-প্রোটেকশন কমিটি, এগুলো মিলেই গড়ে উঠছে সামাজিক সুরক্ষার এক বিকল্প কাঠামো।

পাহাড়সম দারিদ্র্য, জলবায়ু ঝুঁকি আর সামাজিক চাপের মাঝেও জ্যোতিকা ও সুমিরা নতুন স্বপ্ন দেখছে।

কিশোরী ক্লাবগুলো উত্তরাঞ্চলে প্রমাণ করছে- সঠিক তথ্য, সাহস আর সংগঠিত প্রয়াসই পারে একটি বাল্যবিয়ে থামাতে; পারে একটি ভবিষ্যৎ বাঁচাতে।