একাত্তরের আত্মসমর্পণ ও বর্তমান কূটনীতি: ভারত ইস্যুতে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার কথিত হস্তক্ষেপ ও সীমান্তে আগ্রাসনের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিক্ষোভ মিছিল করার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে ভারত প্রসঙ্গে কড়া সমালোচনা করেছেন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতারা।

বুধবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে ‘আধিপত্যবাদবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে একটি ‘আজাদী’ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে শিক্ষার্থীরা ‘দিল্লি না ঢাকা’, ‘ভারত না বাংলাদেশ’ এবং ভারতীয় হাইকমিশনারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ডাকসুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ ‘দ্য ডেল্টাগ্রাম’ নামক একটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে অভিযোগ করেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যার পরিকল্পনায় প্রণয় ভার্মার সরাসরি যোগাযোগ ও সহযোগিতা ছিল। তিনি দাবি করেন, এই কূটনীতিকের বাংলাদেশে থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই। অবিলম্বে তাকে তলব করে ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ভারতে অবস্থানরতদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়ার দাবিও জানানো হয়।

একই দিনে কুমিল্লার দেবিদ্বারে এক পথসভায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি মন্তব্য করেন, ভারত অসন্তুষ্ট হবে—এই ভয়ে দেশের অনেক রাজনীতিবিদ মুখ খুলতে চান না। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস করা হবে না। হাসনাত অভিযোগ করেন, প্রায় ৩০ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে ভারত পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই আশ্রয় দিয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করছে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সীমান্তে বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করা হবে আর বিনিময়ে সালাম দেওয়া হবে, এমন নীতি আর চলবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে ‘স্বামী-স্ত্রীর মতো যে সম্পর্ক ছিল, তা আর মেনে নেওয়া হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অন্যদিকে, রাজধানীর ওয়ারীতে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনায় বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ভারতের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরে ভারতের কাছে নয়, বরং বাংলাদেশের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিল। ভারত সহায়তা না করলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হতো এবং দেশ স্বাধীন হতো। তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত করে অপকর্ম জায়েজ করার চেষ্টা করেছে। একইসঙ্গে তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার গত বছর যে গণহত্যা চালিয়েছিল এবং একাত্তরের ইতিহাস—কোনোটিই মুছে ফেলা যাবে না।

ইশরাক হোসেন আরও বলেন, জিয়াউর রহমান একটি বিভাজনমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে একটি মহল মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার এবং ইতিহাস বিকৃত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের জনগণ সচেতন এবং তারা ব্যালটের মাধ্যমে মিথ্যাচারের জবাব দেবে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশ তাদের প্রয়োজনে সহায়তা করেছিল, কিন্তু বিজয় অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে। রাজনৈতিক দলগুলো ইতিহাস বিকৃত করে যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, তা জনগণ কখনোই গ্রহণ করবে না বলে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।