সিরিয়ার ‘নাজুক’ পালাবদলে আন্তর্জাতিক সমর্থনের আহ্বান জাতিসংঘের

সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের এক বছর পর দেশটিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, গভীর চ্যালেঞ্জ, ‘ভঙ্গুর’ নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং তহবিলের ঘাটতি দেশটির এই রূপান্তর প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন।

জাতিসংঘের রাজনীতি ও শান্তি বিনির্মাণ বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রোজমেরি ডিকার্লো নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, ‘এক বছর আগে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তখন লাখ লাখ সিরীয় নাগরিকের আশা বাস্তবে রূপ নিয়েছিল।’

চলতি মাসের শুরুতে ৬১ বছরের বাথ সরকারের পতনের প্রথম বার্ষিকী পালন করেছে সিরীয়রা। এ বিষয়ে ডিকার্লো বলেন, ‘সামনে অনস্বীকার্য ও কঠিন সব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও সিরীয়রা তাদের দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচারের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।’

সিরীয় কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুদ্ধার করেছে বলে উল্লেখ করেন ডিকার্লো। তিনি জানান, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে একীভূত করে একক কমান্ডের অধীনে আনা, সাংবিধানিক ঘোষণা জারি এবং নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের কাজ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।

বাস্তুচ্যুতির প্রবণতা এখন উল্টো দিকে মোড় নিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থী এবং প্রায় ২০ লাখ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ (আইডিপি) নিজ এলাকায় ফিরে এসেছে। পাশাপাশি অনেক দেশ সিরিয়ার ওপর থেকে দ্বিপাক্ষিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।

মানবিক সহায়তার সুযোগ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন।’ ডিকার্লো সহিংসতার উল্লেখযোগ্য হ্রাসের বিষয়টি উল্লেখ করলেও সতর্ক করে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি এখনও ভঙ্গুর এবং আন্তঃসম্প্রদায়িক সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়ে গেছে।’ বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাত ও দমন-পীড়ন সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে দিয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ইসরায়েলি হামলায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত

জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং অনুপ্রবেশ নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। তিনি গত নভেম্বরের শেষের দিকে বেইত জিনে ইসরায়েলি বাহিনীর অনুপ্রবেশের ঘটনা উল্লেখ করেন। সিরীয় কর্তৃপক্ষের মতে, ওই ঘটনায় ১৩ জন নিহত হন এবং বহু পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়।

ডিকার্লো বলেন, ‘আমি ইসরায়েলকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার জন্য মহাসচিবের আহ্বানের পুনরাবৃত্তি করছি।’

২০২৪ সালের শেষের দিকে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর ইসরায়েল অসামরিকীকৃত বাফার জোন দখল করে সিরীয় গোলান মালভূমিতে তাদের দখলদারিত্ব সম্প্রসারিত করে। এই পদক্ষেপটি সিরিয়ার সঙ্গে ১৯৭৪ সালের ডিসএনগেজমেন্ট চুক্তির লঙ্ঘন।

সম্প্রতি দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলি অনুপ্রবেশ জোরদার হয়েছে। স্থানীয়রা তাদের কৃষিজমিতে দখলদারিত্ব, শত শত একর বনভূমি ধ্বংস, বাসিন্দাদের গ্রেপ্তার এবং সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপনের অভিযোগ করেছেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ায় এক হাজারেরও বেশি বিমান হামলা এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে ৪০০টিরও বেশি আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালিয়েছে।

স্থায়ী শান্তির জন্য জবাবদিহিতার ওপর জোর দিয়ে ডিকার্লো বলেন, ‘অতীতের এই ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ হিসাব-নিকাশের মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত নিরাময় শুরু হতে পারে। এর জন্য নিখোঁজদের ভাগ্যের সুরাহা করতে হবে এবং রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারসহ গুরুতর নৃশংসতার জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

মানবিক সহায়তা ও তহবিল সংকট

মানবিক প্রয়োজনের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সহকারী মহাসচিব জয়েস মসুয়া বলেন, সিরিয়া ঘুরে দাঁড়ানোর এক বিরল সুযোগ পেয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এই অগ্রগতি অব্যাহত আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর নির্ভর করছে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান মুহূর্তটি সিরিয়াকে অবশেষে এই প্রয়োজনগুলো মেটানোর সুযোগ করে দিয়েছে।’ তিনি উত্তেজনা হ্রাস, বিনিয়োগ এবং সরকার-নেতৃত্বাধীন পুনরুদ্ধারে সমর্থনের ওপর জোর দেন।

২০২৫ সালের মানবিক আবেদনের মাত্র ৩০ শতাংশ তহবিল সংগৃহীত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি ক্রমবর্ধমান ঘাটতি নিয়ে সতর্ক করেন। মসুয়া বলেন, ‘তহবিল হ্রাসের এই প্রবণতা রোধ করা না গেলে আরও বেশি মানুষ পিছিয়ে পড়বে এবং পুনরুদ্ধারের কাজ কেবল কঠিনই হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই এই মুহূর্তটিকে কাজে লাগাতে হবে।’