২০২৬ সালে বিশ্বজুড়ে আরও ‘সংঘাত ও অস্থিরতার আশঙ্কা’

২০২৫ সাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, ২০২৬ সালে বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে। ইউক্রেন ও সুদানে চলমান যুদ্ধ, গাজায় ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি এবং ভেনিজুয়েলা ও তাইওয়ান ঘিরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণে আগামী বছরটি বিদায়ী বছরের চেয়ে কম অস্থির হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সংঘাত বিশ্লেষণ বিভাগের অধ্যাপক নিওফাইটাস লোইজাইডস আনাদোলু এজেন্সিকে জানান, আগামী বছরগুলোতে সংঘাতের সামগ্রিক হার বাড়বে। তিনি বলেন, ‘আগামী কয়েক দশকে আমরা যতটা সংঘাত দেখব, তার চেয়ে বেশি সংঘাত দেখা যাবে আগামী কয়েক বছরে।’

তার মতে, এই ঝুঁকি কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে নয়, বরং বিশ্বজুড়ে একই সময়ে ঘটা নানা ঘটনা থেকে তৈরি হচ্ছে, যা সামাল দিতে সরকারগুলো হিমশিম খাচ্ছে।

চীন ও তাইওয়ান উত্তেজনা

২০২৬ সালে অন্যতম স্পর্শকাতর ভূ-রাজনৈতিক স্থান হতে পারে তাইওয়ান। বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা এবং চীনের সম্ভাব্য আগ্রাসন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। চলতি মাসে ওয়াশিংটন তাইওয়ানের কাছে ১১.১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। অন্যদিকে, নভেম্বরে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের পরিকল্পনা উন্মোচন করেছেন, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে তাইপেইয়ের উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ।

লোইজাইডস বলেন, ‘আমরা জানি যে চীনা নেতৃত্ব তাদের সামরিক বাহিনীকে ২০২৭ সালের মধ্যে আগ্রাসনের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে।’

তিনি সতর্ক করেন, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে আঞ্চলিক অন্য শক্তিগুলোও এতে জড়িয়ে পড়তে পারে। তার মতে, ‘জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও কোরিয়ার মতো দেশগুলো এটিকে চীনের পুন একত্রীকরণ হিসেবে দেখবে না, বরং তারা এটিকে নতুন সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি ও অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বিস্তার হিসেবে দেখবে। তাই আমরা দেখতে পারি দেশগুলো তাইওয়ানকে রক্ষায় এগিয়ে আসছে।’

লোইজাইডস আরও বলেন, ‘এটি পুরো অঞ্চলের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।’

যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনিজুয়েলা ২০২৫ সালে ভেনিজুয়েলায় বিতর্কিত নির্বাচন, নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং তেলবাহী ট্যাংকার আটকের ঘটনার পর ওয়াশিংটন ও কারাকাসের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনিজুয়েলার ওপর ‘টোটাল অ্যান্ড কমপ্লিট ব্লকেড’ বা পূর্ণাঙ্গ অবরোধ ঘোষণা করেছেন, যার আওতায় ভেনিজুয়েলার উপকূলের কাছে একটি ট্যাংকারও জব্দ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, দুর্নীতি ও মাদক পাচার রোধে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কারাকাসের অভিযোগ, মাদকবিরোধী অভিযানের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করে ভেনিজুয়েলার তেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। লোইজাইডস মনে করেন, তাইওয়ানের মতো না হলেও এখানেও সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।

গাজায় ভঙ্গুর পরিস্থিতি

বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজাসহ বেশ কিছু চলমান সংঘাত ২০২৬ সালেও অব্যাহত থাকতে পারে। দুই বছরের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েলি লঙ্ঘনের কারণে সেখানে ৪১১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১,১১২ জন আহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে মোট নিহতের সংখ্যা ৭১ হাজার ছাড়িয়েছে, যার বড় অংশই নারী ও শিশু।

বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত মনে হলেও লোইজাইডস দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘চুক্তি মেনে চলার বিষয়ে ইসরায়েলের কোনো আগ্রহ নেই। যেকোনো ছোটখাটো লঙ্ঘন, তা বাস্তব হোক বা কাল্পনিক, সেটিকে তারা অসম হামলার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘গাজার ক্ষেত্রে ইসরায়েল মানবাধিকার ও মানবিক নীতি লঙ্ঘন অব্যাহত রাখতে পারে।’

কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের প্রভাষক রব গিস্ট পিনফোল্ডও একই মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল সরে আসবে বা হামাস অস্ত্র সমর্পণ করবে—এমন কোনো লক্ষণ নেই। ফলে সংঘাত চলতেই থাকবে... এটি একটি ধীরলয়ের ও কম তীব্রতার সংঘাতে রূপ নিতে পারে।’

সুদান ও ইউক্রেন সংকট

সুদানের সেনাবাহিনী ও র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যকার গৃহযুদ্ধ তৃতীয় বছরে পা রাখতে যাচ্ছে, যেখানে উত্তেজনা কমার কোনো লক্ষণ নেই। লোইজাইডস বলেন, ‘দেশভাগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করা হলেও তা কাজে আসেনি।’ তার মতে, বিকেন্দ্রীকরণ বা ফেডারেল ব্যবস্থা আরও ভালো পথ হতে পারত।

অন্যদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ সমাধানের বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান। ট্রাম্প প্রশাসনের ২৮-দফা প্রস্তাবনা ও কূটনৈতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও লোইজাইডস মনে করেন, যেকোনো চুক্তি সংঘাতকে কেবল থামিয়ে রাখতে পারে। তিনি বলেন, ‘এটি নির্দিষ্ট কিছু ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণকে কার্যত স্বীকৃতি দেয়, যদিও আইনি স্বীকৃতি দেয় না।’

মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্যান্য সংঘাত

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ফ্রন্টলাইনগুলোও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। পিনফোল্ড লেবাননকে সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, যুদ্ধবিরতি থাকলেও ইসরায়েল প্রতিনিয়ত হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে। এছাড়া ২০২৫ সালের জুনে ইসরায়েলি বিমান হামলার জেরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের সংঘাত হয়, যা এখনো পুরোপুরি মেটেনি। পিনফোল্ড বলেন, ‘ইসরায়েল সরকার এখনো ইরানি সরকারের প্রতি অত্যন্ত বৈরী এবং উল্টোটাও সত্য। তাই এই সংঘাত মেটেনি, আপাতত স্থগিত আছে।’

এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ২০২৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছিল। ওই বছরের ২২ এপ্রিল ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পাহালগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিমান ও ড্রোন হামলা হয়, যা দেশ দুটিকে আরেকটি বড় সংঘাতের কাছাকাছি নিয়ে যায়। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তেও ২০২৫ সালের জুলাইয়ে সরাসরি সশস্ত্র সংঘাত হয়েছিল, যা পরে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়।

বিশ্লেষকরা আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের কথাও উল্লেখ করেছেন। কঙ্গো ও ইথিওপিয়ার উত্তেজনা এখনো কমেনি, যা যেকোনো সময় বড় আকার ধারণ করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তারা।