অধিনায়ক মাশরাফিকে নিয়ে এতো খোঁচানো কেন?

চার ম্যাচে মোট ৩৪ ওভার বোলিং করে রান দিয়েছেন ১৬০, ইকোনোমিক রেট ৪.৭০। চলতি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বোলার মাশরাফি বিন মর্তুজার পরিসংখ্যান এটা। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশের কোন বোলারের রানরেট পাঁচের নিচে তো দূরের কথা ছয়ের নিচেও নেই। শুধু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নয়, মাশরাফি নিয়মিত এমন বোলিং করে আসছেন অনেক আগ থেকেই। আর অধিনায়ক মাশরাফির গল্পটা তো সবারই জানা। তবে এই মাশরাফিকেই অবসর নিতে বাধ্য করতে উঠেপড়ে লেগেছে একটা পক্ষ, সুযোগ পেলেই যারা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠছে।

গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে হারার পর অনেককে বিস্মিত করে হঠাৎ তোলা হয়েছিল মাশরাফির অবসরের কথাটা। তারপর থেকেই সুযোগ পেলে বিভিন্নভাবে উঠছে এই কথা। শ্রীলঙ্কা সিরিজের আগে পরিস্থিতি বড্ড ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। আল্টিমেটামও নাকি দেওয়া হয়েছিল মাশরাফিকে!

শ্রীলঙ্কা সিরিজে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন মাশরাফি। ভেতরের খবর, মাশরাফিকে বাধ্য হতে হয়েছিল ওই সিদ্ধান্ত নিতে। তারপর গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু ‘অবসর’ আলোচনা পিছু ছাড়েনি মাশরাফির। দুদিন আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের বিপক্ষে যখন আর একটি হার, ওয়ানডে থেকেও অবসর নেয়ার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো মাশরাফিকে। 

এমন একজনকে বারবার অবসরের অন্য অনুপ্রাণিত বা বাধ্য করা হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা, কিন্তু মুখ খুলবেন কে? শ্রীলঙ্কায় মাশরাফি যখন অবসরের ঘোষণা দিলেন, হাউমাউ করে কেঁদেছেন তাসকিন আহমেদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোসাদ্দেক হোসেনরা। তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর মতো সিনিয়রদের জন্যও বিষয়টি ছিল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। কিন্তু রুখতে পারেননি কেউই।

এই মাশরাফিতেই বাংলাদেশের আজ ‘বড় দল’ হয়ে উঠা। সবাই সেটা মানেনও। দেশ-বিদেশে এ বিষয়ে নিত্যদিন কথাও হচ্ছে। মাশরাফি বন্দনা চলছে সবখানেই। কিন্তু মাশরাফিকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকা ‘ঘুন’ মারবে কে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট যখন ছন্নছাড়া এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে তখন আবির্ভাব মাশরাফি বিন মর্তুজা নামের এই জাদুকরের। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের শুরুর দিকে মুশফিকুর রহিমের অধীনে হারতে হারতে করুণ একটা অবস্থায় গিয়ে পৌছেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট। ২০১৫ বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির আগমন।

তারপর থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বর্ণালী অধ্যায়ের শুরু। ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা, ঘরের মাটিতে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়। এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বীরত্ব দেখানো। শ্রীলঙ্কায় গিয়ে সিরিজ ড্র করে আসা। তারপর প্রথমবার আইসিসি ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের ছয় নম্বরে ওঠা, চলতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা। আইসিসি আয়োজিত কোন টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রথম সেমিফাইনালে ওঠার ঘটনা।

এতো সব অর্জনে পেছনে নিয়মিত চোখে পড়েছে মাশরাফির অধিনায়কত্বের কারিশমা। বোলার মাশরাফির অবদানও ভোলার মতো নয়। এসব ভুললেও দলটাকে যেভাবে পরিবার বানিয়ে ফেলেছেন মাশরাফি সেটা কিভাবে ভুলবে ওই পক্ষটি।

ভারত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে ফেরানোর পর উল্লাসরত বোলার মোস্তাফিজকে জড়িয়ে ধরে কপালে যেভাবে চুমু একে দিলেন মাশরাফি, ওই মুহূর্তটা কি ভোলা যাবে! তাসকিন আহমেদকে নিষিদ্ধ করার পর ভারতে কাঁদো কাঁদোভাবে সংবাদ সম্মেলনে যেভাবে প্রতিবাদ করলেন সেটা কি ভোলা যাবে! তামিম, মাহমুদুল্লাহ, নাসিরদের মতো দলের প্রতিটি ক্রিকেটারের বিপদের সময় ‘বড় ভাইয়ের’ মতো যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন মাশরাফি সেটা কি ভোলা যাবে! এমন মাশরাফির বিকল্প কই বর্তমান দলে?

সাকিব আল হাসানকে ওয়ানডের পরবর্তী অধিনায়ক ভাবা হচ্ছে। টি-টোয়েন্টিতে মাশরাফির অবসরের পর সাকিবের কাঁধেই নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয়েছে। তবে সাকিব এখনো যথেষ্ট পরিনত কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের। বিভিন্ন সমস্যার কথা উঠলে ২০১১ সালে সাকিবের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেসব এখনো কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কিনা তাতে সন্দেহ অনেকের। এমন পরিস্থিতি কাকে উপযুক্ত ভেবে মাশরাফির অবসর বিষয়টি উস্কে দেওয়া হচ্ছে?

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে মাশরাফিকে অবসর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পরিস্কার করে কিছু বলেননি তিনি। তবে এটা বলেছেন, খেলাটা এখনো উপভোগ করছেন তিনি। আর যতদিন উপভোগ করবেন খেলা চালিয়ে যাবেন। মাশরাফি খেলা উপভোগ করে যাক। এবং বরাবরের মতো শত প্রতিবন্ধকতা জয় করে টিকে থাকুক। গুটিকয় বাদে সবাই যে চাইছেন, আগামী ২০১৯ বিশ্বকাপেও অধিনায়কত্বের ভারটা মাশরাফির কাঁধেই থাকুক।