লাইনে দাঁড়িয়েও মিলে না টিকিট, ভিআইপিদের দৌরাত্ম্যে যাত্রীরা দিশেহারা

প্রতিবছর ঈদ উৎসবে রেলযাত্রা করতে যেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় যাত্রীদের। বিশেষ করে রেলের টিকেট নিয়ে অনিয়মের যেন শেষ নেই। ফলে ট্রেনের টিকেট যেন হয়ে গেছে সোনার হরিণ। ভিআইপিদের দৌরাত্ম্য আর স্বজনপ্রীতির ফলে যাত্রীদের জান যায় লাইনে দাঁড়িয়ে। আর বাড়ি ফেরার কষ্ট মলিন হয় ঘামে ভিজে কিংবা ট্রেনের ছাদে চড়ে বা বগিতে ঝুলে!

১ সেপ্টেম্বর ঈদুল আজহা ভেবে অগ্রিম টিকিট বিক্রি করা শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পরে চাঁদ উঠার পর জানা গেল, ঈদ হতে যাচ্ছে ২ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকেই শুরু হয় কানাঘুষা। ১ সেপ্টেম্বর ট্রেন চলবে কি চলবে না এ সিদ্ধান্ত জানাতে গড়িমশি করে রেল কর্তৃপক্ষ। শেষমেশ কোন ধরণের ঘোষণা ছাড়াই ১ সেপ্টেম্বরের টিকেট বিক্রি শুরু করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ফলে যাত্রীদের বড় একটি অংশ জানতেই পারেনি ১ সেপ্টেম্বর ট্রেন চলবে।

প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে টিকেট নিয়ে নানা ধরণের নয়-ছয় মার্কা সিদ্ধান্তে যাত্রীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। অনেকের সামর্থ থাকলেও রেলের বিকল্প বাহনে করে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। রেলের টিকিট প্রত্যাশী এমন একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এবার ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট নিয়ে শুধুমাত্র কালোবাজারি নয়, যথারীতি কেলেঙ্কারি হয়েছে। যার মূল হোতা স্বয়ং রেল মন্ত্রণালয় এবং রেল কর্মকর্তারা। ভিআইপিদের জন্য ৫ শতাংশ রেল টিকিট বরাদ্দের কথা বলে বেহাত করা হয়েছে সিংহভাগ টিকিট।

কাউন্টারে টিকেট বিক্রির আগেই কিভাবে টিকেট ফুরিয়ে যায় তা নিয়েও ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে যাত্রীদের মনে। আগাম টিকেটে কিনতে এসে প্রায় প্রতিদিনই যাত্রীরা অভিযোগ করেন যে, সারারাত নির্ঘুম লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও যখন কাউন্টার থেকে বলা হয় এসি টিকিট শেষ, তখন বোঝাই যায় বিক্রির আগেই টিকিট কালোবাজারি হয়েছে।

‘ভিআইপি’ নামের এসি টিকেট বিক্রির সময় প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত থাকলেও সাধারণ যাত্রীরা লাইনের প্রথমে দাঁড়িয়েও এ টিকেট হাতে পাননি। জানা গেছে, রেলের ‘ভিআইপি’ টিকিট কেটে নেয়া হয়েছে খোদ রেলমন্ত্রী, মন্ত্রীর ড্রাইভার, পিএস, এপিএস, পিএ ও নাতি পরিচয় ব্যবহার করে। মন্ত্রীর পরিচয় দিয়ে শুধুমাত্র ৩১ আগস্টের শতাধিক প্রথম শ্রেণির টিকেট কেটে নেয়া হয়েছে।

ভিআইপি টিকিটের চাহিদাপত্র ও টিকিট বরাদ্দের যে নথিপত্র এসেছে তাতে দেখা যায়, রেলমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের লোকজনের নামে যেসব টিকিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার যাত্রী তারা নিজেরা নন। তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তি ও দলীয় নেতা-কর্মীরা মন্ত্রী ও মন্ত্রাণালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বাগিয়ে নিয়েছেন। অথচ রাত জেগে সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করে লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীরা হয়েছেন বঞ্চিত।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব উপসচিব, এমপি ও উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, রেলওয়ে শ্রমিকলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা এবং রেলের কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ভিআইপি টিকেট কেটে নিয়েছেন।

রেলস্টেশনের টিকিট বরাদ্দপত্রের যে তালিকা, তার প্রায় অর্ধেকের বেশি রেলভবন সংশ্লিষ্ট। রেলের ডিসিও এবং ডিটিও টিকিটগুলো বাতিল করে বিশেষজনদের দেয়ার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি অনেকের টিকিটের চাহিদাপত্র গ্রহণ করে পরে টিকিট না দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

টিকেট নিয়ে এমন অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করলে কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী বলেন, রেলের টিকেট সীমিত। তাই চাইলেও সবাইকে টিকিট দেওয়া সম্ভব নয়। আর ভিআইপি ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত কোটা রয়েছে। তাদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা আছে এবং সেখান থেকেই তাদের টিকেট দেয়া হয়েছে। বাকি টিকেট কাউন্টারে যাত্রীদের জন্য বিক্রি করা হয়েছে।

এদিকে ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের একটি রেলসেতুর নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে উত্তারাঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় টিকেট কাটা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে পারেননি অনেক যাত্রী। ট্রেন যাত্রা বাতিল হওয়ার পর টাকা ফেরত নিতে এসেও তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন অনেকে। বাতিল হওয়া মৈত্রী ট্রেনের যাত্রীরা এখনো টিকিট মূল্য ফেরত পাননি বলে জানিয়েছেন। আর যারা ফেরত পেয়েছেন তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার ট্রেন যাত্রা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের যেন কোন শেষ নেই।