তিলে তিলে ক্ষয় হল এক কিংবদন্তির জীবন

‘কেউ তো জানে না প্রাণের আকুতি বারে বারে সে কি চায়। ধরণীর বুকে পাশাপাশি তবু কেউ বুঝি কারো নয়।’ গানের এ কথা মালার সাথে যেন সত্যিই জীবন মিলে গেল কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল জব্বারের। আরও কিছু দিন বাঁচার আকুতি জানালেও জীবনের কাছে পরাজিত হলেন এই কণ্ঠসৈনিক। বুধবার, ৩০ আগস্ট সকালে ৭৯ বছর বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

গত ৩১ মে আব্দুল জব্বার কিডনি, হৃৎপিণ্ড, প্রস্টেটসহ নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এসব জটিল রোগের চিকিৎসা চালাতে যেয়ে শিল্পীর পরিবার অর্থাভাবে পড়েন। ক্রমেই তার অস্থার অবনতি ঘটলে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়।

যে কণ্ঠসৈনিক ১৯৭১ সালে কোলকাতার পথে পথে গান গেয়ে ১২ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সে শিল্পী জীবনের শেষ সময়ে এসে টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছিলেন না। অসহায় শিল্পী হয়ত তখন মনে করছিলেন তার গাওয়া গানের সেই কথাগুলো- ‘ধরণীর বুকে পাশাপাশি, তবু কেউ বুঝি কারো নয়।’ দুঃখের দহনে, করুণ রোদনে তিলে তিলে হাসপাতালের বেডে জীবন ক্ষয় করেছেন তিনি।

হাসপাতালে কাটানো জীবনের শেষ দিনগুলোতে যখন তিলে তিলে তার জীবন ক্ষয় হচ্ছিল, তখন তিনি আকুতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি যদি জাতি গঠনের সংগ্রামে গান গেয়ে গেয়ে কোন ভুমিকা রেখে থাকি তবে, ষোল কোটি মানুষ এক টাকা করে আমাকে দিন। আমার সুচিকিৎসা হলে আমি বেঁচে যাবো।’

আব্দুল জব্বার বলেছিলেন, ‘চিকিৎসা না পেয়ে আমার অবস্থা আরো খারাপ হলে যখন আমাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হবে তখন অনেকে দেখতে আসবেন! মারা গেলে শহীদ মিনারে নিয়ে লাশে ফুল দেবেন! তাতে আমার কোন লাভ হবে না। আমার কিছু টাকা দরকার। আমি আরো কিছুদিন বাঁচতে চাই।’

নীল দরিয়ার সুর সম্রাটের এমন করুণ পরিণতির কথা শুনে কয়েকজন বিত্তবান এগিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু তাদের সেই সাহায্য পর্যপ্ত ছিল না। ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে, কাগজের পাতা ভরে। জীবন পাতার অনেক খবর, রয়ে যায় অগোচরে’ ঠিক এমনিভাবে শিল্পীর জীবন পাতার শেষ দিনগুলোর খবরও যেন রয়ে গেছিল আগোচরে। তাই শিল্পীর পরিবারের মানুষ তখন দেশবাসী এবং সরকারের কাছে চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন জানায়।

শিল্পীর মৃত্যুর আগে তার স্ত্রী শাহীন জব্বার অক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'রাষ্ট্রের এতোবড় একটি সম্পদ চোখের সামনে শেষ গেলেও সরকার তাঁর চিকিৎসার কোন দায়িত্ব নিচ্ছে না। শিল্পী বুড়ো হয়ে গেছেন, দেশকে দেওয়ার মতো তার কাছে এখন আর কিছু নেই, তাই সে মরে গেলে দেশের কিছুই যায় আসে না!'

শিল্পীর পরিবারের এই আক্ষেপের পর সরকারের তথ্যমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে শিল্পীর চিকিৎসা খরচ বহন করার কথা জানালেও ততক্ষণে শিল্পী যেন তিলে তিলে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ‘নীল দরীয়া’ শিল্পীকে ছেড়ে দিয়েছেন তার বুক থেকে। একলা ঘরে তাঁর মন মন বধূয়া পথ চেয়ে থাকলেও জীবন তরী নিয়ে তিনি আর কখনোই পৃথিবীর সারেঙ বাড়ির ঘাটে নোঙর করবেন না।