ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত সেই ছাত্রী রাগে-ক্ষোভে যা বললেন
- Details
- by ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
শহীদ মিনারে একটি ছাত্রীকে লাঞ্চিত করার যে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেই ছাত্রী আজ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর আগে আজ ০৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। মিছিল শেষে রোকেয়া হলের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে আটকদের মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত ক্লাশ বর্জনের ডাক দিয়েছেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পূর্বে মরিয়ম মান্নান নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ২ জুলাই শহীদ মিনার এলাকায় তার সঙ্গে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল:
‘যাদের তুলে নেয়া হয়েছে তাদের জন্য আন্দোলনে যোগ দিতে আমি এসেছিলাম। আসার কিছুক্ষণ পরে, যে ভাইটাকে মেরেছে, ফারুক ভাই (যুগ্ম আহ্বায়ক); তাকে আমি কখনো দেখি নাই। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন পরিচয় ছিল না। যে কোন মানুষ যদি দেখে একটা মানুষকে রাস্তায় ফেলে কুকুরের মতো মারতেছে, তাহলে তাকে অবশ্যই বাঁচানোর চেষ্টা করবে। আমিও তাই করেছিলাম। ভিড়ের মধ্যে তাকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম।'
মরিয়ম বলেন, 'এরপর আমার সঙ্গে কী ঘটেছিল তা আপনারা সবাই দেখেছেন। এরপরেও যদি আপনাদের বিবেকবোধ না জাগে তবে কী বলব যে, আমাকে কোথায় কোথায় ধরছে? আপনাদের শুনতে ইচ্ছে করতেছে, আমাকে কোথায় কোথায় ধরছে? আমাকে কীভাবে কী করছে? সবাই আমাকে ফোন দিচ্ছে, তোমাকে কী করছে! এখন আমি লাইভে যাব? লাইভে যেয়ে বলব, আমাকে কী করছে? কেমন করে ধরছে? আমি কান্না করব আর সবাই আমাকে সিম্প্যাথি (সহানুভূতি) দেখাবে?'
তিনি বলেন, 'সিম্প্যাথি দেখানোর মেয়ে আমি না। আমি একটি যৌক্তিক আন্দোলনে আসছি। একজন মানুষ হিসেবে আমার কিছু অধিকার আছে। এখানে আসার অধিকার আমার আছে। বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমাকে পুলিশ ধরে নাই। আমার যদি অন্যায় হয় আমাকে কোর্টে চালান করে দিক। আমি সেখানে কথা বলব। বাইরের ছেলেপেলে আমাকে কেন ধরলো? আমার গায়ে কেন টাচ করলো? এগুলো শুনতে ইচ্ছে করতেছে আপনাদের? দেখেন নাই?'
মরিয়ম বলেন, 'আমাকে নারীবাদিরা ফোন দিয়েছে, সাংবাদিকরা ফোন দিয়েছে। তারা বলেছে, তোমার সাথে আছি আমরা। আরেকজন কল দিছে, সে বলছে, 'তুমি বলবা, একজনকে মারছিল তুমি তাকে বাঁচাতে গেছো, তারপর তোমাকে লাঞ্চিত করছে।' আরে বাবা, আমি তো আসছিই এ মানুষগুলোর কাছে। কেন আমি মিথ্যা বলব? আমাকে ছেলে-পেলে যখন ধরলো, ধরার পরে আমাকে থানায় নিয়ে গেল। থানায় নিয়ে আমাকে বলবে না, কেন আমাকে আটক করা হল?'
তিনি বলেন, 'আমাকে যখন সিএনজিতে তোলা হল, আমি জানি না ওরা কারা। আমাকে বলেছে, 'ওরা ছাত্রলীগ'। আমি তো জানি না ওরা কী করে? ফারুক ভাইকে যখন নিয়ে গেল, আমি সাইড হয়ে গেলাম। সবাই একদিকে মিডিয়া-প্রেস। আমি সিএনজিতে উঠেছি বাসায় চলে যাওয়ার জন্য। ওই সিএনজিটা ঘিরে ধরেছে মিনিমাম ২০০ মটরসাইকেল। শহীদ মিনার থেকে কিছুটা দূরে ধরার পরে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার ফোন-ব্যাগ নিয়ে গিয়েছে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। (আমাকে) ধাক্কাচ্ছে। এরপর যে নোংরা কথাগুলো বলেছে সেগুলো আমি বলতে পারবো না।'
লাঞ্চনার শিকার এই শিক্ষার্থী বলেন, 'সিএনজির ভিতরেও ঢুকছে। তারপরে কী করছে, এগুলোও বলবো? কীভাবে কীভাবে আমাকে টাচ করছে? আমাকে বলছে, আমি বেশ্যা। এরপরে আমাকে নিয়ে গেল শাহবাগ থানায়। কিন্তু সিএনজির প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার কাছে মনে হয়েছে জাহান্নাম। ওরা যখন বলছে থানায় নিয়ে চল মা*টাকে, তখন মনে হয়েছে থানা আমার জন্য সেফ। কিন্তু থানায় যেয়ে মনে হল থানা আমার জন্য সেকেন্ড জাহান্নাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাগ খুলল। বলল, ‘ও তো ইয়াবা খায়’। তারা আমার ব্যাগ থেকে বের করলো একটা ছুরি। আমি কেন ছুরি নিয়ে আসব? আমি তো বলে আসছি, ‘আমি আন্দোলনে যাচ্ছি, ভাইদের কাছে যাচ্ছি’।'
বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'তারা ছুরি বের করলো, লাইটার বের করলো, আরো কী কী বের করলো। বের করে বলল, আমি ইয়াবা খাই। আমাকে জোর করতেছে বলতে যে, আমি ইয়াবা খাই। আমি নেশা করি। আমি বললাম, আমার ব্যাগটা তারা নিয়ে গিয়েছিল। আমার ব্যাগে কিচ্ছু ছিল না, ছিল ওয়াটার পট আর দুটো মেকাপ। আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তারা ফোর্স করতে লাগলো। এটা বলে, ওটা বলে, দুজন সাংবাদিকও এলো। আমি তাদেরকে বললাম কী, আমার বাসায় একটু কল দিতে। আমি তখনো জানি না আমার ছবিটা ভাইরাল হয়েছে। এর মধ্যে আমাকে মানসিকভাবে টর্চার তো করেই যাচ্ছে, স্বীকার করানোর জন্য যে, আমি নেশা করি আর ওই জিনিসগুলো আমার।'
প্রতিবাদী এই নারী বলেন, 'এই আচরণ আমার দেশের পুলিশ করেছে। এটা আমার দেশ না। আমার দেশ হলে আমার থানায় বসে, যেখানে আইন থাকে সেখানে বসে আমি এত বেশি হ্যারাজ হতাম না। আমি ‘মানুষের দেশে’ থাকি। এটা যদি আমার দেশ হতো তাহলে তো আমি নিরাপদ থাকতাম। আমি যখন বারবার কান্না করে বলতেছি আমার বাসায় একটা ফোন দিতে দেন, আমি বাসায় যাব। দিচ্ছে না, বলে কী, নেতা হবা? নেতা হতে হলে জেল খাটতে হয়। আমি তখনো জানি না, তাদের ফোনে আমার ছবি দেখতেছে! আর বলতেছে, জাতীয় নেতার কাপড় খোল তো, জাতীয় নেতাকে দেখতো। তখনো আমি বুঝতেছি না আমারে দেখতেছে।'
মরিয়ম গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, 'অনেকখন ধরে একটা মেয়ে কনস্টবল আমার পাশে বসা। সে আমাকে বারবার ওই ছবিটা দেখানোর চেষ্টা করতেছে। আজকে আমি তাদেরকে (আন্দোলনকারীদের) বাঁচাতে গিয়েছি বলে আমার এই অপরাধগুলো হইছে? তারা আমাকে স্বীকার করাচ্ছে, কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক গোপন খবর আমি জানি। তাদেরকে তা দিতে হবে! না হলে ফারুককে কেউ বাঁচাতে গেল না, আমি কেন গেলাম? একটা কুকুরকে এভাবে মারলেও তো মানুষ যায়, সেখানে একটা মানুষকে মারছে, আমি যাব না?'
তিনি আরো বলেন, 'বাসায় আমি একটা কল দিতে পারি নাই। পরে আমি এটা জেনেছি, সবাই ছবিটা দেখার পরে হসপিটালগুলোতে আমাকে খুঁজেছে। কারণ কেউ জানত না আমি এখানে এসেছি। ফেসবুকে আমি একটা পোস্ট দিয়ে বের হয়েছিলাম যে, ‘আমি চুপি চুপি বাসা থেকে বের হচ্ছি, ভাইদের পাশে দাঁড়াবো বলে। আমরা যদি না যাই, আমাদের ভাইরা একা হয়ে যাবে। সরি মা এবং আপু।’ আমি এরকম একটা পোস্ট দিয়ে এসেছিলাম।'
'এরপরে অনেক রাতে একজন এসে বলল, বাসার কারো নাম্বার দেন। আমি বাসার ঠিকানাসহ কয়েকজনের নাম্বার দিলাম। তখন রাত ৯টা বাজে। আমি ভাবলাম আমি ছাড়া পেয়ে যাব। আমি নিশ্চিন্ত। এরপর এসে বলল, এখান থেকে যাওয়ার পর বাসায় যেয়ে তো ঘুমাবেন, এদিকে আর আসবেন না। আর যাওয়ার আগে আপনাকে একটা স্বীকারোক্তি দিতে হবে। তাও চুপ করে আছি কোন কথা বলছি না। আমি বলাম কী, আমার মাকে একটা কল দেন, সে এসে আমাকে নিয়ে যাক। সে বলল, কারো জানা লাগবে না। ১৭ কোটি এখন আপনাকে চেনে। বলে চলে গেল' উল্লেখ করেন মরিয়ম।
মরিয়ম বলেন, 'আমাকে আর ছাড়ছে না , রাত ১১টা বাজে, ১২টা বাজে। রাত ১টার দিকে আমার বাসা থেকে লোক আসলো। আসার পরে বলল, এত রাতে একটা মেয়ে, ওকে ছেড়ে দেন। আমার দুলাভাই আবার পুলিশে চাকরি করে। সে ফোন দিয়েছিল। আমার সামনে তাকে বললো, আপনার শালী তো একটা বেয়াদব। আপনি পুলিশে চাকরি করেন বলে ছেড়ে দিলাম। ফোনটা রাখার পরে বলল, দুলাভাই যদি পুলিশ না হত। আজকে বেশ্যা বলে কোর্টে চালান করে দিতাম। কোন বাপ ছিল না বাঁচানোর। কনস্টেবল মেয়েরা পর্যন্ত আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে এই বলে যে, আজকে ব্রাজিলের খেলা, এই মা*টার জন্য আমরা খেলা দেখতে পারছি না। আমি যদি অন্যায়ও করে থাকি, তাদের ডিউটি তারা আমাকে পাহারা দেবে। তারা এসে আমাকে বলতে পারে আমার জন্য তারা ব্রাজিলের খেলা দেখতে পারছে না?'
ছাড়া পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'পরের দিন দুপুরে আমাকে ছেড়েছে। আমার বাসা থেকে যে এসেছে তার কাছে আমাকে দিল না। রাতে আমাকে রাখলো একটা নোংরা রুমে, যেখানে চোর-কয়েদিরা থাকে। একটা মোবাইল চোর মেয়ে, যার তিন দিনের রিমান্ড হয়েছে তার সাথে আমাকে রাখলো। আমি যখনই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম, তখনই এসে আমাকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছিল। ওই মেয়েটা এসে আমাকে বললো কী, ‘আপা আপনার বাড়ির লোক আইছে। আপনারে এহন ছাইড়া দিবে।’ তখন অনেক রাত, আমি বলাম কী যদি না ছাড়ে? মেয়েটা বলে, ‘আপনি তো কোন দোষ করেন নাই।’ আমি বললাম, ওরা যে বললো। ওই মেয়ে বললো, ‘আন্দোলন করা কী অন্যায় নাকি? আপনি তো আন্দোলন করছেন অন্যায় করেন নাই। আমি কত আন্দোলন দেখছি টিএসসিতে। আন্দোলন যারা করে তারা অন্যায় করে না।’
'একটা চোর মেয়ে সে যদি বোঝে আন্দোলন করা কোন অন্যায় নয়। সেখানে যারা শিক্ষিত মানুষ তারা বলতেছে, যারা আন্দোলন করে তারা রাজাকারের বাচ্চা, তারা খারাপ, এরা দেশদ্রোহী। এরা শিবির-এরা জামায়াত। আজকে যারা টাকার হিসেবটা চাচ্ছে, আজকে যারা বলতেছে এদের ইন্ধন দিচ্ছে কারা? ইন্ধন দিচ্ছে ৩০ লাখ ছেলে মেয়ে। যদি কৈফিয়ত নিতে হয় ওদেরকে ধরে আনেন। পলিটিক্যাল কোন মানুষ ইন্ধন দেয় নাই। দিছে সাধারণ ছেলে মেয়ে। সাধারণ ছেলে মেয়েগুলো কোথায়?' বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই নারী।
মরিয়ম আরো বলেন, 'আমি সবার সামনে সবার জন্য এসেছিলাম। আমি আমার পেটের দায়ে আসি নাই। আসছিলাম কুকুরের মত মরে যাচ্ছে ছেলেগুলো, তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আমি সবার সামনে যেমন এসেছিলাম আজকে আমি তেমন সবার সামনে চলে যাব। কেন চলে যাব জানেন? ওই ৩০ লাখ ছেলে-মেয়ে এখানে নাই। আমি যখন লাঞ্চিত হইছি তখন আমার পাশে কেউ ছিল না। আমি কাদের জন্য আসছিলাম? আমার ভাইয়েরা কই? সেই ভাইয়েরা কই যাদের জন্য আমি আসলাম? যারা বলেছিল পাশে দাঁড়াবে সেই একটা ভাইকেও তো আমি দেখি না।'
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করছে আমি কী চাই? বলছে আমাকে সম্মান দিবে! আমাকে লাঞ্চিত করা হইছে, আমাকে সম্মান দিবে! আমি যে কারণে আসছিলাম, আন্দোলনে আসছিলাম না? যদি আমাকে সম্মান দিতে হয়, প্রজ্ঞাপন যেন আমাকে এনে দেয়। আমার গা থেকে যেন বেশ্যা ট্যাগটা তুলে দেয়। এই ট্যাগ তুলে দিয়ে আমি সাধারণ ছাত্রী, এটা যেন বলে দেয়। আমি শিবির না, আমি জামায়াত না, এটা যেন তুলে দেয়। আমার আজকে কারো উদ্দেশ্যে কিছু বলার নাই। আমার ক্ষোভ শুধু ওই ৩০ লাখ ছেলে-মেয়ের প্রতি, যাদের জন্য আমি আসছিলাম। আমি আমি তাদের জন্যই এখন চলে যাব। কোটার সাথে এই মুহূর্ত থেকে আমার কোন সম্পর্ক নাই। এখন বাসায় চলে যাব। আমাকে কী করছে তা জানার জন্য ছবিগুলো এনাফ (যথেষ্ট)।'
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.