সেন্টমার্টিন দ্বীপে শৈবাল, প্রবাল, কচ্ছপ, লাল কাকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ ও উভয়চর প্রাণী এবং পাখিসহ নানা জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হবার পথে। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ, যথেচ্ছারভাবে হোটেল-মোটেল নির্মাণ, নির্বিচারে গাছ কর্তন করে বন উজাড়, মানুষের মলমূত্রসহ নানা বর্জ্য ও প্লাস্ট্রিক সামগ্রীর বর্জ্যে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশে দারুন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

saint martin

দ্বীপটি ধ্বংসের পেছনে আরো বলা হচ্ছে, পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে প্রতিনিয়ত সেন্টমার্টিন স্তরের মিষ্টি পানি উত্তোলন, ২০০ ইট কংক্রিটের হোটেল, বহুতল ভবন নির্মাণ, ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং খোলা পায়খানা নির্মাণসহ নানা পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে কোরালসহ জীববৈচিত্র্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৮.৩ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপটিতে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে আরও ৯ হাজার পর্যটক সেখানে অবস্থান করে। এতে ১৮ হাজার মানুষের চাপ নিতে হয় দ্বীপটিকে। তাই দ্বীপটি এতটাই শংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে যে, হারাতে বসেছে তার প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য। চারদিকের বাতাসে দুর্গন্ধ। বলতে গেলে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন তার জীববৈচিত্র্য খোয়াতে খোয়াতে এখন মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। স্বচ্ছ পানি ও চারপাশজুড়ে প্রবাল পাথরবেষ্টিত মনোলোভা পুরো দ্বীপটিই যেন নৈস্বর্গিক। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের পার্শবর্তী ৮.৩ বর্গকিলোমিটারজুড়ে এটির অবস্থান। দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্রও।

সূত্র জানায়, সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির বসবাস ছিল। এসব প্রাণীর অনেকটাই এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন সময়ে তার উপর আবার দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য।

saint martin bd

সূত্র জানায়, অতিরিক্ত পর্যটক এ দ্বীপের ভারসাম্যের জন্য হুমকি এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে বলেও পরিবেশ সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পাশে ছেঁড়া দ্বীপ। এ দ্বীপের চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিুনক, শামুকের খোলস, চুনা পাথরসহ প্রায় কয়েক শত প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। এখন জনশূন্য এই ছেঁড়া দ্বীপের অপরূপ দৃশ্য দেখতেও কাঠের অথবা স্পিডবোটে ছুটে যাচ্ছে পর্যটকরা। এতে দিন দিন এ দ্বীপের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে।

পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এবং সংবেদনশীল এই দুটি দ্বীপকে পরিবেশগত বির্পয় থেকে রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও আইইউসিএন এর সাবেক কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং সংবেদনশীল। এখানে যদি কোনো রকম পরিবেশগত বা যে কোনো কারণে বিপর্যয় হয় তাহলে এটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন কাজ হবে। দ্বীপটিকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক যে অবয়ব ছিল এগুলো যদি ব্যাহত হয় তাহলে দ্বীপের বিপর্যয় হবেই।

তিনি আরও বলেন, দ্বীপের বিভিন্ন উদ্ভিদরাজীসহ বহু প্রাণী ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সামুদ্রিক কাছিমসহ বিভিন্ন প্রাণী সেন্টমার্টিন ও ছেড়া দ্বীপে ডিম পাড়তে আসতো। জরিপ করে দেখা গেছে, এর সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অতিরিক্ত মানুষ সমাগমের কারণে ডিম পাড়াসহ বিচরণের পরিবেশ না থাকায় এসব কচ্ছপের দ্বীপে আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এজন্য এখই যদি পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কামরুল হাসান জানান, সেন্টমার্টিনে পর্যটক আগমন বৃদ্ধি পাওয়াকে পুজিঁ করে গত দুই দশকে এ দ্বীপে বহু হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। গড়ে তুলেছে অনেক বহুতল ইমারত। এসবের একটিতেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বা অনুমতি নেই। এসব স্থাপনা করতে গিয়ে পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি সমুদ্র সৈকতের বালি আহরণ করা হয়েছে। এ দ্বীপে আগে তালগাছসহ অনেক উঁচু গাছপালা ও কেয়াবন ছিল, তাও কেটে স্থাপনা নির্মাণ করেছে অনেকে। জিও টেক্সটাইল দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এসব ব্যবসায়ীরা দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করছে ।

তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে তাদের অবৈধ এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কামরুল হাসান আরও বলেন, পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতন করতে নানা প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন জীববৈচিত্র্য উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গঠন করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এই কর্মকর্তা জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর খুবই পাতলা। এখানে অতিরিক্ত পর্যটক আগমনের কারণে পর্যটন মৌসুমে অতি মাত্রায় সুপেয় পানি উত্তোল করা হয়। যার দরুন দ্বীপের উত্তরে অর্ধশতাধিক নলকূপে লবণাক্ত পানি দেখা দিয়েছে। এতে সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাপনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প তৈরির দাবি স্থানীয়দের। পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের উপদেষ্টা বিশ্বজিত সেন জানান, এখনি রক্ষা করা না গেলে এই দ্বীপটি সাগরেই বিলীন হয়ে যাবে। এখন শ্রীহীন এই দ্বীপটির পানিতে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখার অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

‘তিন বছরের জন্য সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ রাখতে হবে। আর এই তিন বছরের মধ্যে সেন্টমার্টিনের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে’, বলেন বিশ্বজিত।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসাইন জানান, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সেন্টমার্টিনের সমস্ত ইট কংক্রিটের ভবন উচ্ছেদ করা হবে। এজন্য ইতিমধ্যে একাধিকবার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, সেন্টমার্টিনে অতিরিক্ত মানুষের বসতি গড়ে উঠার পাশাপাশি পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের অবস্থান করাই এই দ্বীপের প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। মানুষের ময়লা আবর্জনা সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ জলের নীচের অংশে জমাট হচ্ছে। এতে প্রবাল পাথরসহ পানির পরিবেশ ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হতে চলেছে। পানি দূষণরে কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্যও হারিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সেন্টমার্টিন ও ছেড়াদ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয়ের সিনিয়র কেমিস্ট ও সহকারীর পরিচালক কামরুল হাসান জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর গৃহীত জীববৈচিত্র্যে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও ছেড়া দ্বীপের আন্ডার ওয়াটার ক্লিনিংয়ের জন্য পানির নিচে যে প্লাষ্টিক ও অন্যান্য ময়লা রয়েছে তা নিয়মিত পরিস্কার করা হবে। এ সব ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করতে কাজ করবে ডুবুরির দল। এই প্রকল্পের কার্যক্রম এক বছর পর্যন্ত চলবে। এছাড়া অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কচ্ছপ সংরক্ষণ ও প্রজনন, সেন্টমার্টিন পরিচ্ছন্ন ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা  এবং সেন্টমার্টিন পরিবেশ সুরক্ষায় নিয়মিত অভিযান।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, 'সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং দ্বীপের পরিবেশ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা কর খুবই দরকার। অতিরিক্ত পর্যটকদের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ইতিমধ্যে দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ প্রকৃতির অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।'

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.