রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন, স্ট্যান্ড রিলিজ সেই অ্যাসিল্যান্ড

রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন সম্পন্ন হওয়া সেই মুক্তিযোদ্ধা ও তার ছেলের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার দায়ে অভিযুক্ত দিনাজপুর সদরের সেই এসিল্যান্ড (ভূমি) আরিফুল ইসলামকে চাকরি থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ দেয়া হয়েছে। সোমবার সকালে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার অফিস তাকে এ তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দেয়।

এক বুক অভিমান নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন

নিজের ছেলেকে চাকরিচ্যুত ও বাস্তুচ্যুত করায় গত বুধবার এক বুক অভিমান নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান দিনাজপুরের সদর উপজেলার যোগীবাড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। এর ঠিক এক দিন আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাতীয় সংসদের হুইপ ও সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিমকে একটি চিঠি লেখেন তিনি।

সেই চিঠিতে বলা হয়, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট আমার শেষযাত্রার কফিনে আমি চাই না। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করিও।

মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের এ ওসিয়ত অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাকে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা (গার্ড অব অনার) ছাড়াই দাফন করা হয়। আর এর প্রেক্ষিতেই দিনাজপুরের সেই এসিল্যান্ড (ভূমি) আরিফুল ইসলামকে চাকরি থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি (স্ট্যান্ড রিলিজ) দেয়া হয়। ইসমাইল হোসেনের ছেলে নুর ইসলাম ওই এসিল্যান্ডের গাড়ির চালক হিসেবে চাকরি করতেন।

এদিকে সোমবার সকালে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের কবর জিয়ারত করতে যান। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধার ছেলেকে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম হাসপাতালে একটি চাকরি দেয়ার ঘোষণা দেন।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর এম আবদুর রহিম হাসপাতালের জন্য একটি জিপ গাড়ি উপহার দিয়েছেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গাড়িটি হাসপাতালে চলে আসবে। আর তখন থেকে গাড়িটি চালাবেন নুর ইসলাম।

ইসমাইল হোসেনের সেই চিঠি থেকে জানা যায়, হুইপের সুপারিশের প্রেক্ষিতে তার ছেলে নুর ইসলামের 'নো ওয়ার্ক নো পেমেন্ট' ভিত্তিতে এসিল্যান্ডের গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি হয়। কিন্তু কর্মস্থলে বিভিন্ন সমস্যার কারণে তার ছেলে হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ করেন। এ সময় হুইপ এডিসি (রাজস্ব) কে বিষয়টি দেখতে বলেন।

কর্মস্থলের বিভিন্ন সমস্যার কথা হুইপকে অবহিত করায় নুর ইসলামকে প্রথমে তার বসবাসরত খাস পরিত্যাক্ত বাড়িটি ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়। পরে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসিল্যান্ডের স্ত্রী নুর ইসলামকে টয়লেট পরিষ্কার ও মাংস রান্নার করতে বলেন। কিন্তু মাংস রান্ন ভালো না হওয়ায় এবং বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পাশাপাশি তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনিও ক্ষিপ্ত হয়ে যান। এমনকি মাপ চাওয়ার জন্য তার ছেলে স্ত্রী সন্তানসহ এসিল্যান্ডে স্ত্রীর কাছে গেলে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও দেখা করতে পারেনি।

চাকরিচ্যুত হওয়ায় তার ছেলে উপায় না পেয়ে ফের হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু প্রশাসন বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। বর্তমানে তার ছেলে সন্তান সন্ততি নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে বাসস্থানহীন জীবন-যাপন করছে।

চিঠিতে আরো বলা হয়, তিনি দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু নিজের হাতে স্বাধীন করা দেশেই তার ছেলের রুজি-রোজগারটুকু অন্যায়ভাবে কেড়ে নিয়েছে। তাই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হুইপের কাছে চিঠিটি লেখেন তিনি। ইকবালুর রহিমের কাছে আবেদন জানান, তিনি যেনো ন্যায় বিচার করেন। ঠুনকো অভিযোগে চলে যাওয়া তার ছেলের চাকরিটি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ছেলের হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়ায় তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইলের মৃত্যুর পর গত বৃহস্পতিবার তার জানাজা শুরুর আগে ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশের প্রশাসনের একটি চৌকসদল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করতে যান। কিন্তু এ সময় তার স্ত্রী ও সন্তানরা পিতার ওসিয়তের কথা ম্যাজিস্ট্রেটকে সাফ জানিয়ে দেন।

তার সন্তানরা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেন, একজন জেলা প্রশাসক জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন পান। তিনি জেলার পিতা। কিন্তু তার সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা দেখা করতে গিয়েও দেখা করতে পারেন না। এর চেয়ে লজ্জার কিছু হতে পারে না। এ কারণে তাদের পিতা মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রত্যাখান করেছেন। আর তার ওসিয়ত অনুযায়ী তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান জানানো ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।