আজ না খেয়ে মরবো নাকি কাল করোনায়?

মরণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব একটি বড় অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এ কথা বলে আসছেন। বিশেষ করে মঙ্গাপীড়িত দেশগুলো খুব বেশি ঝুঁকিতে আছে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। তেমনই একটি দেশ দক্ষিণ আমেরিকার হাইতি। দেশটিতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সন্ধান মেলার পর বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন হন। এর কারণে যে দেশটিতে আবারো হতে পারে দুর্ভিক্ষ।

ত্রাণ সংগ্রহ করছেন হাইতির জনগণ

তাদের মতে, হাইতির ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাত এই মহামারি মকাবেলা করতে পারবে না। এই আশঙ্কা থেকেও তাদের ভাবিয়ে তুলছে মহামারির কারণে অর্থনৈতিক পরিণতি। এই পরিণতি দেশটির দরিদ্রদের জন্য করোনার চেয়েও ভয়াবহ প্রাণঘাতী রূপে হাজির হতে চলেছে।

প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি এখন পর্যন্ত দেশটিতে সেভাবে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত ৮৮ জনের দেহে ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মারা গেছে নয় জন। এমন পরিস্থিতিতে সরকার থেকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি অনেকের কাছেই বিলাসিতার মতো। কারণ অধিকাংশ নাগরিকই অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতের ওপর নির্ভর করে দিন এনে দিন খেয়ে বেঁচে থাকে।

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হাইতি। তবুও আগামী ১১ মে থেকে সরকার সবাইকে মাস্ক পরে বাইরে বের হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।

মাস্ক পড়তে কোনো বাধা নেই, তবে জনগণের সমস্যা অন্য জায়াগায়। তাদের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আজ না খেয়ে মরবো নাকি কাল করোনায়?

গত ১৯ মার্চ হাইতিতে প্রথম করোনা রোগীর সন্ধান মেলে। এরপর থেকেই দেশটিতে আতঙ্কিত হয়ে লোকজনের কেনাকাটা বেড়ে যায়। জনগণ সাধ্যের বাইরে গিয়েও বেশি পরিমাণে কেনাকাটা করছেন। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির। গত বছরের এই সময়ে চালের দাম যা ছিল; বর্তমানে তা দেশটির কিছু কিছু বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।

রাস্তায় হাঁটছেন দুই হাইতিয়ান

দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটিতে দেড় বছর আগে একবার মন্দা দেখা দিয়েছিল। সেই আশঙ্কার মেঘ আবারো হাইতির আকাশে জমা হচ্ছে। এ বছরের মার্চে নতুন করে শুরু হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি।

এক অনলাইন অর্থনৈতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে হাইতির প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুথে জানান, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের জন্য হাইতির অর্থনীতি প্রায় চার শতাংশ সঙ্কুচিত হতে পারে।

দেশটির প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এতজার এমিলি বলেন, এখানকার অর্ধেকের বেশি নাগরিক কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি খাতের অবদান মাত্র ২১ শতাংশ। করোনাভাইরাসের আগমনে দরিদ্র শ্রমিক, যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারের মালিক তাদের আয় চলতি মৌসুমে কমে গেছে। তাদের পরবর্তী মৌসুমের ফসল চাষের প্রস্তুতি গ্রহণ থমকে গেছে।

হাইতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগেই জাতিসংঘ থেকে এক সতর্ক বার্তায় জানানো হয়, চলতি বছর হাইতি চরম আর্থিক সংকটে পড়বে। দেশটির ৪০ শতাংশ মানুষের জরুরি মানবিক ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।

জাতিসংঘের এই সতর্ক বার্তাই ইঙ্গিত করে দেশটি আবারো একটি দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সংস্থাটি থেকে আরো বলা হয়, মার্চের শুরুর দিকেই হাইতিতে ৩০ লাখ মানুষ মারাত্মক খাদ্য অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন।

হাইতির স্থানীয় এক বাজারে উপচে পড়া ভিড়

গত কয়েক বছর প্রবাসী হাইতিয়ানরা কোটি কোটি ডলার পাঠিয়ে দেশকে গভীর দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করে আসছেন। প্রতিবছর তারা ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেন। এটি দেশটির মোট জিডিপির প্রায় এক তৃতীয়াংশ। ভাইরাসটির দমন ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের দেয়া লকডাউনের কারণে তারাও উপার্জন করতে পারছেন না। ফলে চরম এক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

দেশটির অর্থনীতিবিদ কেসনার ফ্যারেল বলেন, এমন একটি অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, হাইতিয়ানরা খাবার, শিক্ষা এমনকি শেষকৃত্যের জন্যও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করেন। অধিকাংশ প্রবাসীই বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে মহামারি সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করায় তাদের সঙ্গে আমরাও বিপদে।