রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছিলেন যে ঠেলাগাড়ি চালক!

এখনকার নেতারা নির্বাচনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করেন। কিন্তু এই দেশে সম্ভবত একজনই জননেতা ছিলেন, যিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার আগের দিনও ঠেলাগাড়ি চালিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছেন। অবশ্য ঠেলাগাড়ির পাশাপাশি বাবুর্চির কাজও করতেন। বাবুর্চি থাকা অবস্থায় একবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করেছেন। অথচ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন কপর্দকহীন। মারাও যান টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে। তিনি সিলেটের একসময়ের নিরন্ন মানুষের নেতা ‘ছক্কা ছয়ফুর’।

বক্তৃতা করছেন ছক্কা ছয়ফুর

‘আধুনিক’ মানুষের কাছে তার গল্প মনে হতে পারে উন্মাদের কীর্তিকলাপ। কিন্তু এর ভেতর দিয়েই তিনি হয়েছিলেন জনমানুষের নেতা। যেভাবে মানুষের উপকার করা যায় তিনি সেভাবেই রাজি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার পর করলেন ইউপি নির্বাচন! তার কয়েক বছর পর প্রার্থী হলেন উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে। হারিয়ে দিলেন হেভিওয়েট সব প্রার্থীদের! অদ্ভুত ছিল তার নির্বাচনী অঙ্গীকারও। বলতেন, রাস্তাঘাট পাকা করার দরকার নেই। রাস্তা তুলে দিয়ে খাল করে ফেলতে হবে। নদীমাতৃক দেশে সবাই চলাচল করবে নৌকায়।

ছয়ফুর রহমান ছিলের ভীষণ প্রতিবাদী। সারাদিন পরিশ্রম করার পর বিকেলে মাইক টাঙিয়ে বক্তৃতা শুরু করতেন সিলেটের কোর্ট পয়েন্টসহ বিভিন্ন জায়গায়। দেশের নানা দুর্নীতির প্রতিবাদ করতেন। ধীরে ধীরে লোক জড়ো হতে থাকতো। শ্রমজীবী মানুষই ছিল তার শ্রোতা। একসময় বক্তৃতা শেষ হলে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলতেন, কথা তো শুনলেন, আমার মাইক ভাড়া দেবে কে? এই বলে হাত পাততেন মানুষের কাছে। মাইক ভাড়া উঠে গেলে আর একটা টাকাও নিতেন না তিনি।

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। সেসময় যারা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতেন তাদেরকে গার্ড দেওয়ার জন্য পুলিশের একটি দল পাঠানো হতো। তিনি পুলিশ প্রোটেকশন প্রত্যাখান করেছিলেন এই বলে- ‘আমি নিজেই তো খেতে পাইনা, হাতি (পুলিশ) খাওয়াবো কী দিয়ে! নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হল। একদম খারাপ করেননি ছয়ফুর রহমান। প্রায় ৬০ জন প্রার্থীর মধ্যে হয়েছিলেন অষ্টম। লোকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে হাসতে হাসতে বলতেন, ‘আমি হলাম দেশের ৮ নম্বর প্রেসিডেন্ট, আগের ৭ জন মারা গেলে আমিই দেশ চালাতাম!

আমি হলাম দেশের ৮ নম্বর প্রেসিডেন্ট, আগের ৭ জন মারা গেলে আমিই দেশ চালাতাম!

১৯৯০ সালে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হলেন। একটা হ্যান্ডমাইক নিয়ে নিজেই প্রচারণা চালাতেন তিনি। পেছনে শ্রমজীবী মানুষের ছোট্ট একটা দল জুটতো, তারাই আবার এক-দুই টাকা দান করতেন এই প্রার্থীকে। একদিন প্রতিপক্ষ প্রার্থীর গুণ্ডা বাহিনী তার ওপর হামলা চালায়, মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। তবে তারপর থেকেই পরিস্থিতি ঘুরে যায় ১৮০ ডিগ্রি।

হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ তার পক্ষে রাস্তায় নেমে পড়ে। প্রার্থী ভোটারদের টাকা দেবেন কী, উল্টো ভোটাররাই টাকা দিয়ে ছয়ফুর রহমানকে নিয়ে যায় এখানে-ওখানে। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় সৃষ্টি হয় গণজোয়ার। অবশেষে ৫২ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচনে জিতে যায় তার ডাব মার্কা! নির্বাচনে ছক্কা পেটানোয় (জেতা) তার নাম হয়ে যায় ‘ছক্কা ছয়ফুর’।

নীতিবান মানুষরা এই সমাজে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। ছক্কা ছয়ফুরের ক্ষেত্রেও তাই হল। নির্বাচিত হয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন। ইউনিয়ন পরিষদে বসালেন পাহারা। ফলাফল, সব ইউপি চেয়ারম্যানরা তার বিরুদ্ধে একট্টা হয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন। মন্ত্রণালয় থেকে তার উপজেলা চেয়ারম্যান পদ স্থগিত করা হল। কিছুদিন পর বিএনপি ক্ষমতায় এসে ১৯৯১ সালে যখন উপজেলা পরিষদ বাতিল করে তখন ছক্কা ছয়ফুরও হারিয়ে যান আলোচনা থেকে।