সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না অনেকে

বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এরপর থেকে দীর্ঘ পাঁচ মাস কেটে গেছে। রোগী কমার কোনো লক্ষণ নেই। এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখের কাছাকাছি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সরকারি হিসেবে সুস্থতার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। তবে সুস্থ হলেও ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণ মারাত্মক প্রভাব রেখে যাচ্ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে বিবিসিতে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েচে।

সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না অনেকে, শরীরে দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব থেকে যাচ্ছে

সেখানে তারা বলছেন, আক্রান্ত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন, তাদের অনেকের শরীর এবং মনের ওপর নেতিবাচক নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে অনেকেই অভিযোগ জানাচ্ছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো প্রটোকল না থাকায় রোগীরা কী করবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। যদিও রাজধানীর দুই-একটি হাসপাতাল ইতোমধ্যে ফলোআপ চিকিৎসা চালু করেছে।

করোনা থেকে সুস্থ হওয়া রোগীদের ভাষ্য

করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ৬৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মর্তুজা আহমেদ ফারুক জানান, আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দুই মাস আগে বাসায় ফিরেছেন। কিন্তু এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। শরীরে একটা দুর্বলতা রয়ে গেছে। সেটির কারণে শোয়া বা বসা থেকে উঠলে এবং হাঁটলে মাথা ঘোরে। যথেষ্ট বিশ্রাম নেয়া এবং নিয়মিত প্রোটিন খাওয়ার পরও এমনটা হচ্ছে। ফলে এখনো স্বাভাবিক কাজকর্ম করার জন্য ফিট হতে পারেননি।

শুধু যে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে তা নয়। বরং অনেক তরুণ ও যুবকের শরীরেও করোনাভাইরাসের নেতিবাচক একটি প্রভাব থেকে যাচ্ছে। যেমন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত ২৯ বছর বয়সী আজিজা বেগম জানান, শ্বাসকষ্ট নিয়ে গুরুতর অবস্থায় গত এপ্রিল মাসে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে। সেখান থেকে মে মাসের মাঝামাঝিতে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কাজেও যোগ দিয়েছেন। কিন্তু ভাইরাসটির প্রভাবে তার শরীরে জটিলতা বেড়েছে এবং মনে তৈরি হয়েছে ভয়।

তিনি বলেন, আগে থেকেই শরীরে ডায়াবেটিস ছিল। কিন্তু এখন রোগটি আপডাউন করার পাশাপাশি ব্লাড প্রেশারটাও ধরা পড়েছে। আবার আবহাওয়ার কারণে এই সময়ে একটু গলা ব্যথা হলেই ভয় লাগে। মনে একটা শঙ্কা চলে আসে। যার কারণে এখনো স্বাভাবিক অনুভব করা যাচ্ছে না।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিক মো. সাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রায় মাস তিনেক আগে নয় দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। ৩০ বছর বয়সী ওই সাংবাদিক জানান, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর তিনি এখন স্মৃতি ভ্রমের মতো সমস্যা অনুভব করছেন।

তিনি বলেন, এখনো খুবই শারীরিক দুর্বলতা অনুভব হয়। হঠাৎ হঠাৎ স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন- আমি কাউকে ফোন করবো, যখন হয়তো আমি ফোন করতে যাই, তখন আমি কাকে ফোন করবো, সেটা ভুলে যাই। প্রতিনিয়ত এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু আগে এ সমস্যা ছিল না।

যা বলছেন চিকিৎসকরা

এ বিষয়ে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. টিটো মিয়া বলেন, কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া মানুষের শরীরে মানসিক অবসাদ থেকে শুরু করে স্মৃতিভ্রমের মতো জটিল সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমে তারা মানসিক অবসাদে ভুগছেন, পরে তাদের মধ্যে শারীরিক দূর্বলতা দেখা দিচ্ছে। তখন সুস্থ রোগীদের কিছু করতে ভালো লাগে না এবং কিছু করতে ইচ্ছেও করে না। আবার কারো কারো মাঝে প্যানিক ভাবটা থেকে যাচ্ছে। ফলে হঠাৎ করেই মনে হয় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা দম বন্ধ হয়ে আসছে।

সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না অনেকে, শরীরে দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব থেকে যাচ্ছে

তিনি বলেন, আরো কিছু সমস্যা দেখা যায়। যার প্রভাবে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। বিশেষ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাটা আরো জটিল আকারে দেখা দেয়। শরীরে জ্বর থাকে না। কিন্তু ফুসফুসে পরিবর্তনটা থেকে যাচ্ছে। আবার অনেকের হার্টে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে হার্ট ফেইলোরও হয়ে থাকে। হার্টের রিদমে সমস্যা হয়। হার্টবিট কখনো স্লো হয়ে যায় বা খুব বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ জটিল সব রোগীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তারাই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন জানিয়ে ডা, টিটো বলেন, সুস্থ হওয়ার কয়েক মাস পরও নানা অভিযোগ নিয়ে তাদেরকে আবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে। যাদের গুরুতর অবস্থায় বিশেষ করে নিউমোনিয়া বা অক্সিজেন সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অথবা যাদের আইসিইউতে থাকতে হয়, তাদের ক্ষেত্রে হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার পর সমস্যাগুলো বেশি হয়। এমন সংখ্যাটা ২০ শতাংশের কম নয়।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

এদিকে ভাইরাসটি থেকে সুস্থ হওয়ার পর এর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিকল্পনা নেই বলছেন চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এমনিতেই দেশে করোনা পরীক্ষা করানো এবং রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে মানুষকে আগ্রহী করতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। ফলে সুস্থ হওয়ার পর নানা জটিলতা সত্ত্বেও তার ফলোআপ চিকিৎসা করানোর সংখ্যাটা কম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলেন, সুস্থ হওয়ার পর তিনি নিজেও দীর্ঘ মেয়াদের নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু সরকারি কোনো প্রটোকল না থাকায় নিজ থেকেই এখন ডাক্তারের কাছে ফলোআপ চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন বলে মনে করে তিনি বলেন, করোনার সময় যেমন বলা হয়, এই নম্বরে ফোন করো বা এই হাসপাতালে যাও। এক্ষেত্রেও সেভাবে বলা উচিত। বিশেষ করে যারা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় গিয়েছিল, তাদের এতদিন পর এই এই হাসপাতালে যেতে হবে।