হঠাৎ কেন ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তুরস্ক?

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হাঁটছে তুরস্ক। সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে তেল আবিবে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছে আঙ্কারা। অবশ্য দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক দীর্ঘ ৬০ বছরের। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। তাই আঙ্কারার পক্ষ থেকে নতুন করে কূটনৈতিক নিয়োগ নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান

যদিও তুরস্কের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি। তবে আল মনিটরের বরাত দিয়ে আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টার অংশ হিসেবেই আঙ্কারা এ পদক্ষেপ নিয়েছে।

ইসরায়েলে নতুন তুর্কি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন উফুক উলটাস (৪০)। তিনি অত্যন্ত চতুর, প্রশিক্ষিত এবং কট্টর ফিলিস্তিনপন্থী বলে পরিচিত।

জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে হিব্রু ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এই কূটনীতিক। তিনি ইসরায়েলের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞও।

বিশ্বের প্রথম মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তুরস্ক। এরপর থেকে তারা ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেই ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ২০০২ সালে রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর। অবশ্য প্রথম দিকে তিনি তেল আবিবের সঙ্গে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও পর্যটন খাতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। এমনকি ২০০৫ সালে শান্তির বার্তা নিয়ে ইসরায়েল সফর করেছিলেন।

পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০০৮-২০০৯ সালে এসে। তখন গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি নগরিকদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েল। সেই আক্রমণকে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন ধীরে ধীরে নিজেকে ইমলামপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকা এরদোয়ান।

তুরস্ক ও ইসরায়েলের পতাকা

এরপর ২০১০ সালে ইসরায়েলের দেয়া গাজা অবরোধ ভাঙতে খাদ্য-ওষুধ সহায়তা নিয়ে গাজামুখী যায় তুর্কি নৌকা 'মাভি মারমারা'। সেটিতেও হামলা চালায় ইসরায়েল। এ হামলায় ৯ তুর্কি নাগরিক ও এক মার্কিন-তুর্কি সহায়তাকর্মী নিহত হন। এর পরই দেশ দুটির মধ্যকার দীর্ঘ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০১৬ সালে আবারও সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মাথায় ২০১৮ সালে এসে তা আবারও ভেঙে যায়। অবশ্য তাদের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় আছে।

নতুন করে আবারও কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করার ব্যাপারে বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনটা হলে তা কেবল দুই দেশের বাণিজ্য বাড়াতেই সাহায্য করবে। তুরস্কের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে আন্তর্জাতিক চাপও থাকতে পারে।

বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের চাপে ও বাণিজ্যিক-ভূরাজনৈতিক সুবিধা পেতে গত তিন মাসের ব্যবধানে চারটি আরব মুসলিম রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। যা মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিবকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

অন্যদিকে, একই সময়ে অত্র অঞ্চলে বেশ চাপে রয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যে আছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব, বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এলে নতুন করে চাপ বাড়বে। কারণ, সিরিয়া, লিবিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা বাইডেন প্রশাসন কঠোরভাবে দমন করতে পারে বলে শঙ্কা করছে আঙ্কারার। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও চাপ রয়েছে। সবমিলিয়ে ইসরায়েলে নতুন রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্তের পেছনে এসব প্রভাব দেখছেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক লিসেল হিনৎজ আলজাজিরাকে বলেন, এরদোয়ান সুন্নি মুসলমানদের নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চান এবং সেই লক্ষ্যে তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে এখন তাদের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা চলছে। এমতাবস্থায় তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এটিকে তাদের বিজয় হিসেবেই তুলে ধরতে চাচ্ছেন।

তুরস্কের এক সাবেক কূটনীতিক বলেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতেই এমন পদক্ষেপ নিতে পারে এরদোয়ান সরকার। তবে বিষয়টি পুরোপুরি ধারণার ভিত্তিতে বলা।