মিশর সৌদি আমিরাতকে যে কারণে কাছে টানছে তুরস্ক

সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২০১৩ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে মিশরের শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না তুরস্কের। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মিশরের সামরিক শাসক আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে স্বৈরশাসক হিসেবে সম্বোধন করে আসছিলেন। তুরস্কের সেই অবস্থান হঠাৎ পাল্টে গেছে। শুক্রবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু জানালেন, মিশরের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়েছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে দুই দেশ।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান

ওই দিন সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথাও বলেন তুকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সৌদি এবং তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বলে বিবেচনা করা হয়। তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার পর এ সম্পর্ক ‘চিরবৈরী’ হয়ে উঠে।

মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির সবচেয়ে বড় বন্ধু আরব আমিরাত। দেশটির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক বেশ তিক্ত। সম্প্রতি কাতারের সঙ্গে সৌদি মিত্রদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সময় বেঁকে বসেছিল দেশটি; তুরস্কের সঙ্গে কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা অবস্থায় কাতারের ওপর থেকে অবরোধ তুলতে রাজি ছিল না আমিরাত।

পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্ক হঠাৎ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে কেন? এর কারণ খুঁজেছেন বিশ্লেষকরা।

ব্লু বে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের অর্থনীতিবিদ টিমথি অ্যাশ বলেছেন, মিশরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া কূটনীতিতে এরদোয়ানের এক অবিশ্বাস্য দিকবদল। বাইডেনের অধীন নতুন বিশ্বব্যবস্থা এবং মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার চিন্তা থেকে তিনি এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন।

এরদোয়ান ও আঙ্কারার প্রতি বাইডেন প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় যেটা ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসন্তোষের কারণ হতে পারে, এমন অনেক কিছু করেছে তুরস্ক। রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনেছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনা জটিলতার মধ্যে পড়েছে। লবিস্ট নিয়োগ করেও কুলকিনারা করতে পারছে না তুরস্ক। যে চীনকে কোণঠাসা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে, সেই চীনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হস্তগত করতে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান তৈরি করতে যাচ্ছে আঙ্কারা। চীনা প্রযুক্তি অনুসরণে জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান তৈরির জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে এরদোয়ানের দেশ।

পাকিস্তানকে অ্যাটাক হেলিকপ্টার বিক্রি করতে চেয়েছিল তুরস্ক। সেখানে বাধ সেধেছে বাইডেন প্রশাসন। তাদের অনুমতি ছাড়া তুরস্ক এ হেলিকপ্টার পাকিস্তানকে বিক্রি করতে পারছে না, কারণ এর ইঞ্জিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত।

এখন কৌশলে এগোচ্ছেন এরদোয়ান। বন্ধু বাড়াচ্ছেন, কোনো বলয়ে ঢুকে পড়ছেন না। ‘উদার গণতান্ত্রিক’ দেশ হিসেবে তুরস্ককে বিশ্বদরবারে পরিচিত করছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিশর, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতকে কাছে টানার যে কৌশল তুরস্ক হাতে নিয়েছে, তাতে যদি দেশটি সফল হয়, তাহলে মার্কিন চাপের মুখে অনেকটাই নিজেকে নির্ভার মনে করতে পারবে দেশটি।

ছোট-খাট মতপার্থক্য ভুলে প্রতিবেশীদের কাছে টানছে তুরস্ক

তাছাড়া, ২০২৩ সালে তুরস্ককে পঙ্গু করে রাখা ‘লুজান চুক্তি’র মেয়াদ শেষ হচ্ছে। রিপাবলিক অব টার্কির শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এ বছরই। এ বছর দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনও। বিষয়গুলোকে সামনে রেখে দীর্ঘদিন ধরেই হোমওয়ার্ক করছেন এরদোয়ান। আফ্রিকায় বিশাল প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছে তুরস্কের। মধ্যপ্রাচ্য সংকটে পরাশক্তিগুলোর বিপরীতে অবস্থান নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে দেশটি। অর্থনীতির দুর্দিন কেটেছে; সূচকগুলোর উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা খাতে এখন সমীহ করার মতো অবস্থানে এরদোয়ানের দেশ। আধুনিক সমরাস্ত্রে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অনেক দেশে রপ্তানিও করছেন তারা।

সম্প্রতি তুরস্ক মহাশূন্য পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালের মধ্যে চাঁদে অবতরণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। কয়েকদিন আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও এরদোয়ান একসঙ্গে তুরস্কের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তৃতীয় চুল্লি উদ্বোধন করেছেন।

এ প্রেক্ষাপটে বড় স্বার্থের জন্য পারস্পরিক ক্ষুদ্র মনোমালিন্য ভুলে যেতে চাচ্ছেন এরদোয়ান। অন্যদিকে, তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে সৌদি, আমিরাত ও মিশরের আগ্রহও রয়েছে। দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক না থাকার কারণে বিভিন্ন দিক থেকে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে তাদের। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি তেলকেন্দ্রিক আগ্রহ কমে যাওয়ার পর নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে পারছে না দেশগুলো। ইয়েমেন থেকে মুহুর্মূহু হামলা এলেও তা কার্যত প্রতিহত করতে পারছে না সৌদি আরব। এ সময়ে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে নিরাপত্তাজনিত হুমকি কাটিয়ে তারা রাজকোষ মজবুত করার কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়ের আবর্তনে মিশরের স্বৈরতন্ত্র এবং সৌদি-আমিরাতের রাজতন্ত্রের খুঁটি এখন আগের তুলনায় হালকা। এ প্রেক্ষাপটে তুরস্ককে দেশ তিনটির প্রয়োজন।

২০১৩ সালের জুলাইয়ে সম্পর্কে ফাটল শুরু হওয়ার পর তুরস্ক এবং মিশরের মধ্যে এ-ই প্রথম কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ হয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুক্রবার সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নের আভাস দেন।

কাভুসোগলু সাংবাদিকদের বলেন, ‘গোয়েন্দা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- দুই পর্যায়েই আমরা মিশরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কূটনৈতিক লেভেলে আমাদের যোগাযোগ শুরু হয়ে গেল।

কোনো পক্ষের দিক থেকে পূর্বশর্ত ছিল না উল্লেখ করে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে ছিন্ন থাকা সম্পর্ক একবারে এবং সহজে জোড়া লাগবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আস্থার সংকট থাকাটা স্বাভাবিক এবং দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই এটা হতে পারে। এখন আমরা নির্দিষ্ট কৌশল, একটি রোডম্যাপের অধীনে আলোচনা শুরু করব এবং তা অব্যাহত থাকবে।’

কাভুসোগলুর মন্তব্যের পর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও বলেন, ‘গোয়েন্দা, কূটনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে মিশরের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। যোগাযোগটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে হয়নি, সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটু নিচ থেকে হয়েছে। আশা করছি, আমরা মিশরের সঙ্গে এ প্রক্রিয়া বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারব।’

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে কাভুসোগলু বলেন, রিয়াদ ও আবুধাবিকে আমরা ইতিবাচক বার্তা দিয়েছি। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তাদের প্রতি আরও উদার মনোভাব দেখাতে চাচ্ছি আমরা।

২০১৮ সালের অক্টোবরে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর সৌদির আরবের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। কাভুসোগলু বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডকে দ্বিপক্ষীয় ইস্যু হিসেবে দেখছে না তুরস্ক। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন না করার কোনো কারণ আমি দেখছি না।’

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ইস্যুতে তুরস্ক ও মিশরের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। লিবিয়া যুদ্ধেও পরস্পর বিপরীত অবস্থান দুই দেশ। ২০১৩ সালের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসানের পর তুরস্ক ও মিশর পরস্পরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছিল।

কিন্তু তুর্কি প্রেসিডেন্টকে সম্প্রতি মিশরীয় একনায়ককে নিয়ে খুব একটা কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে নিজের সুরও নরম করতে দেখা গেছে তাকে।

মিশরের সঙ্গে তুরস্কের এই সম্পর্ক গ্রিসকে সম্ভাব্য হতাশায় ফেলে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। গত বছর কায়রোর সঙ্গে একটি জলসীমা চুক্তি সই করেছে গ্রিস। এতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের একাংশ নিজেদের বলে দাবি করেছে দেশটি।

ইউরোপের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা, মার্কিন চাপ, মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার স্বপ্ন- বিষয়গুলোকে সামনে রেখে নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরদোয়ানের উদারনীতি কতটা কাজে আসবে, তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব।