মিয়ানমারে ‘নীরব বিপ্লব’

মিয়ানমারে গত দুই মাসে অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভে লাখো মানুষ অংশ নিয়েছেন। এদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। কর্মবিরতি পালনকারীরা আশা করছেন, এ কর্মসূচির ফলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এবং জান্তা সরকার গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের দিন গ্রেপ্তার গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সাং সু চির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হবে।

মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে মানুষ

বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, ব্যাংকার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কাস্টমস কর্মকর্তা, শিপিং, রেলওয়ে ও পোশাক শ্রমিকরা জান্তা বিরোধী লাগাতার আন্দোলনে ইতোমধ্যে নানা সরঞ্জামের সংকটে পড়েছেন। বিক্ষোভে অংশ নিয়ে এরই মধ্যে ৫৫০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছে। বহু মানুষকে সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে, অনেকে গুম রয়েছে।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, তারা দেশবাসীর সঙ্গে রাস্তায় নামতে না পারলেও, কর্মবিরতি করছে। ইয়াঙ্গুনের ব্যাংকার আয়ি (২৫) বলেন, ‘আমার হাতে আর কোনো অর্থ নেই, ভয়ের মধ্যে রয়েছি। কিন্তু আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। আমরা অবশ্যই স্বৈরশাসনের পতন ঘটাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেনাবাহিনী তালিকাভুক্ত করে গ্রেপ্তার করবে ভয়ে আমরা রাজপথে যাচ্ছি না। কিন্ত আমরা নীরবে বিপ্লব করছি।’

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকার কাজে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে, না ফিরলে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু এসব হুমকি তাদের অসহযোগ আন্দোলন আরও জোরালো করছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন দপ্তরে কর্মরত থাং বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হচ্ছে। আমার দপ্তরের ৪০০ চাকরিজীবীর বেশিরভাগ কাজে যাচ্ছেন না।’

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুর্বল অর্থনীতির দেশ মিয়ানমার করোনা মহামারিতে এমনিতেই বিপর্যস্ত। দেশটির এক চতুর্থাংশ মানুষের দৈনিক আয় গড়ে এক ডলারের নিচে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, চলমান সংকটের কারণে ২০২১ সালে মিয়ানমারের জিডিপি ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। যদিও সু চির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকারের সময় জিডিপি ছিল ঊর্ধ্বমুখী।

মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে মানুষ

ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানসের (আইএফআরআই) এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ফ্রানকোয়েস নিকোলাস আন্দোলনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘জান্তা সরকার এ ধরনের আন্দোলনের জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না।’

ইতোমধ্যে ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। বুথে কোনো অর্থ নেই। ৫ লাখ কর্মসংস্থানের তৈরি পোশাক খাত সেনা অভ্যুত্থানের আগেই বিকাশ লাভ করেছিল, এখন তার অবস্থাও করুণ। সুইডেনের ‘এইচঅ্যান্ডএম’ এবং ইতালির ‘বেনেটন’র মতো বড় প্রতিষ্ঠান তাদের অর্ডার বাতিল করেছে। অন্যদিকে, দেশটিতে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোর জন্য পোশাক তৈরিকারী চীনা প্রতিষ্ঠানে আগুনে দেওয়া হয়েছে। ফলে লাখো নারী শ্রমিক বেকার এবং তারা গ্রামে ফিরে গেছেন।

বর্তমান পরিস্থিতি কৃষকদের জন্যও ভয়াবহ। বীজ ও সারের দাম চড়ছেই। বিপরীতে কিয়াত মুদ্রার দাম পড়ে যাচ্ছে, উপার্জন কমে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলছে, ইয়াঙ্গুনে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে পাম তেল ২০ শতাংশের বেশি; কাচিনে চালের দাম ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ইয়াঙ্গুনে শুধু মার্চেই জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জান্তার সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি উপেক্ষা করে প্রত্যেক দিনই রাজপথে বিক্ষোভ বাড়ছে। দেশের অর্থনীতি এরই মধ্যে তলানীতে। কিন্তু সরকারের মধ্যে এখন পর্যন্ত নমনীয়তার কোনো লক্ষণ নেই। কারণ হিসেবে নিকোলাস বলছেন, সামরিক জেনারেলদের আয়ের আলাদা উৎস রয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তির অনেকে তাদের সমর্থন দিচ্ছে। ফলে এসব রক্ষাকবচ বন্ধ করা না গেলে আন্দোলন কিংবা আন্তর্জাতিক আহ্বানে পরিস্থিতির খুব একটা বদল হবে না।