‘ফুটবলকে বাঁচাতেই সুপার লিগ’

বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন একটা ক্লাব টুর্নামেন্ট আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছিল। সব গুঞ্জন সত্যি হলো রোববার। এদিন রাতে ইউরোপিয়ান সুপার লিগ আত্মপ্রকাশ করেছে। এরপর থেকেই ফুটবল বিশ্ব দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে টুর্নামেন্টের বিরোধিতাই বেশি করা হচ্ছে। অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলোর মধ্যে দুটি ক্লাবের খেলোয়াড়রা ইতোমধ্যে বিরোধিতা করেছেন।

বিরোধিতা করছেন অনেক ক্লাবের সমর্থকরা। কেউ কেউ ধিক্কার জানাচ্ছেন প্রিয় ক্লাবকে। টুর্নামেন্ট ঠেকাতে হুমকি দিয়ে বসেছে উয়েফা। তাদের সমর্থন দিয়েছে বিশ্ব ফুটবলের অভিভাক সংস্থা ফিফা। তাদের মতে এটা ফুটবল ধ্বংসের একটা পাঁয়তারা এবং ধনী ক্লাবগুলোর আরো ধনী হওয়ার প্রকল্প। এত আলোচনা-সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখেও অনড় টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষ। আগামী আগস্টে টুর্নামেন্ট শুরুর প্রস্তুতির কথা ভাবছেন তারা।

বিতর্কের ঝড়ে অবশেষে মুখ খুললেন রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ও ইউরোপিয়ান সুপার লিগের প্রথম চেয়ারম্যান ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। কাল রাতে একটি টিভি চ্যানেলকে (এল চিরিনগিতো দে হুগোনেস) দেওয়া দুই ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে টুর্নামেন্টের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন এই প্রভাবশালী ফুটবল সংগঠক। তার বলা কথাগুলোর সার কথা, ‘ফুটবলকে বাঁচাতেই সুপার লিগ টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে।’ যদিও বাস্তবতা বলছে অন্য কথা।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত বছরের শুরু থেকে ভুগছে সারা বিশ্ব। এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে ফুটবল অঙ্গণে। প্রাদুর্ভাবের কারণে কয়েক মাস ফুটবল বন্ধ ছিল। মহামারির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বল মাঠে গড়ালেও মাঠে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না দর্শকদের। তাতে করে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়ছে ইউরোপিয়ান জায়ান্টরা। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই সুপার লিগ আয়োজন করা হচ্ছে।

এতে করে ফুটবল বাঁচবে এবং উয়েফার একচ্ছত্র আধিপত্য শেষ হবে। আজ সকালে সাক্ষাৎকারে এমনটিই দাবি করলেন সুপার লিগের চেয়ারম্যান পেরেজ। তিনি বলেছেন, ‘যখন কোনো পরিবর্তন হয় তখন কিছু লোক সেটার বিরোধিতা করে। আমরা সুপার লিগ আয়োজন করছি সংকটময় পরিস্থিতিতে থেকে ফুটবলকে বাঁচাতে। দর্শক কমে যাচ্ছে এবং টিভি স্বত্বের আয় কমে যাচ্ছে। কিছু একটা করার দরকার ছিল। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

পেরেজ আরো বলেছেন, ‘ফুটবলে তরুণদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কারণ নিম্নমানের অনেক বেশি ম্যাচ হচ্ছে। তাদের কাছে এটা উপভোগ্য নয়। বিনোদনের জন্য তারা অন্য জায়গায় ব্যস্ত থাকতে পারেন। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আমাদের ক্লাবগুলোর ৫০০ কোটি ইউরো ক্ষতি হয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদের দুই মৌসুমে ক্ষতি হয়েছে ৪০ কোটি ইউরো। বার্সেলোনার ৩০ কোটি ইউরো।’

সুপার লিগ আয়োজন করা হলে টুর্নামেন্টের প্রায়সব ম্যাচ হবে হাইভোল্টেজ। তাতে দর্শকদের আগ্রহ বাড়বে এবং টিভি স্বত্ব থেকে বেশি আয় হবে। তাই সুপার লিগেই সংকটের সমাধান দেখছেন পেরেজ, ‘যেহেতু টিভি স্বত্ব ছাড়া আর কোনো আয়ের উৎস নেই সেহেতু বড় ক্লাবগুলো নিয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচ হবে। দর্শকরা বেশি উপভোগ করবেন। চ্যাম্পিয়নস লিগের বদলে সুপার লিগ হলে আমরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। যত বড় ম্যাচ তত আয় বেশি হবে। এভাবেই উন্নতি হবে। সুপার লিগই সংকটের একমাত্র সমাধান।’

সুপার লিগ হলে ‘ছোট’ ক্লাবগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আর ‘বড়’ ক্লাবগুলো আরো ধনী হতে পারে। যা ফুটবলের জন্য মোটেও ভালো সংকেত নয়। কিন্তু এমন আশঙ্কার কথা মানতে নারাজ পেরেজ, ‘আমরা বেশি আয় করলে সবার জন্য ভালো হবে। ছোট ক্লাবগুলোর কাছ থেকে আমরা বেশি ফুটবলার নিতে পারব এবং তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারব। তা ছাড়া মূল ১৫ ক্লাবের বাইরে আরো পাঁচ দল আসবে প্রতি মৌসুমে। এটা ধনীদের টুর্নামেন্ট নয়, ফুটবল বাঁচানোর টুর্নামেন্ট।’

সুপার লিগ আত্মপ্রকাশ করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের কাঠামো পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে উয়েফ। যা ২০২৪-২৫ মৌসুম থেকে কার্যকর করা হবে। কিন্তু ততদিনে ফুটবল শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পেরেজ, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন কাঠামো ফুটবলকে বাঁচাতে পারবে না। এটা জিতলে ১২-১৩ কোটি ইউরো পাবো। সুপার লিগ আরো বেশি দেবে। ২০২৪ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ চালু হবে। ততদিনে আমরা শেষ হয়ে যাবো।’

সুপার লিগ চালু হলে শীর্ষস্থানীয় ঘরোয়া লিগগুলোর গুরুত্ব ও আবেদন কমার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও এমনটা মানতে নারাজ রিয়াল প্রেসিডেন্ট। তার মতে একই সঙ্গে সব টুর্নামেন্ট চলবে। পেরেজকে বলা হয় এই টুর্নামেন্টের ‘নাটের গুরু’। তিনিই কেন সুপার লিগ টুর্নামেন্টের চেয়ারম্যান প্রশ্ন উঠেছে এনিয়েও। টুর্নামেন্টের চেয়ারম্যান হতে পারতেন বার্সেলোনা সভাপতিও। এ প্রসঙ্গে পেরেজের ভাবনা অন্যরকম।

তিনি বলেছেন, ‘আমাকে চেয়ারম্যান বানানো হয়েছে অভিজ্ঞতার কারণে। বার্সার আপত্তি থাকলে আমি কালকেই হুয়ান লাপোর্তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারি। কোনো সমস্যা নেই। মঙ্গলবার বার্সা সভাপতি মিডিয়ার সামনে লিগ নিয়ে কথা বলবেন। এটা এখন বৃহত্তর স্বার্থে করা হচ্ছে। উয়েফা মনে করে আমরা তাদের সম্পত্তি এবং আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে। কিন্তু তারা ভুল ভাবছে। তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন শেষ। সময় এখন নতুন শুরুর।’

সুপার লিগ নিয়ে চলছে একটা বাড়তি জল্পনা। মূল ১৫ দলের বাকি তিনটি দল কারা? অনেকেই পিএসজি, বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের কথা ভাবছিল। শেষের দুই দল ইতোমধ্যে সুপার লিগের বিরোধিতা করেছে। পিএসজি এখনো মুখে কুলুপ এঁটে আছে। গণমাধ্যমের খবর পিএসজি ও জার্মানির ক্লাবগুলো সুপার লিগের আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। যদিও পেরেজ দাবি করলেন তাদের আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।