বিশ্বব্যাপী করোনার মহামারি শুরুর পর থেকে বিগত কয়েক মাস বেতন পান না শিক্ষকরা। অথচ তারা জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মেরুদণ্ড গড়ার কারিগরদেরই এখন শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর জো নেই। তাই তো দেখা যায়- শিক্ষক এখন ভ্যান চালক, সবজি বা তরকারি বিক্রেতা কিংবা রাজমিস্ত্রির জোগালদার। এ ছাড়া করোনার সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি, ফল বিক্রি কিংবা অন্য অনেক কিছু করে আজ চলতে হচ্ছে জাতির কারিগরদের। যাদের খোঁজ রাখার দায় ‘কর্তৃপক্ষের নেই’। বরং মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন তারা।

private colleges teachers honurs mastersসম্প্রতি এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেন বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা, ফাইল ছবি

জানা যায়, মহামারিকালে শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে। বিগত ৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছেন না শিক্ষকরা। তাই পেটের দায়ে উল্লিখিত নানা কর্ম করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এমনকি অন্যের কাছে হাত পাততেও হচ্ছে অনেককে। আবার কোনো উপায়ান্তর না দেখে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষক।

অন্যদিকে, ভাড়া দিতে না পেরে অনেক বিদ্যালয় বিক্রির বিজ্ঞাপনও চোখ এড়ায়নি মানুষের। এতে কোমলমতিদের হৃদয় ভেঙেছে। তবুও জীবন-জীবিকা থেমে থাকে না। জীবনের লড়াই চলমান। সেটাই করছেন শিক্ষাগুরুরা। দিনের পর দিন নিজেদের প্রাপ্তির জন্য উচ্চপদস্থদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। কারণ কে শোনে কার কথা। বরং শিক্ষকদের ওপর এখন নতুন আতঙ্ক তথা চাকরি হারানো শঙ্কা ভর করেছে।

national university file photoজাতীয় বিশ্ববিদ্যায়, ফাইল ছবি

জানা যায়, সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক নোটিশে জানিয়েছে, শিক্ষকদের বেতন নিশ্চিত করতে না পারলে বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের অধিভুক্তি বাতিল করা হবে। আর এই নোটিশই এই স্তরের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষকের মধ্যে আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছে। তারা বলছেন, বেতনের নিশ্চয়তা তো নেই-ই। এখন চাকরিটাই হারানোর অনিশ্চতয়তার মধ্যে রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা জানান, অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের কলেজ কর্তৃপক্ষ বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির শর্তে বলা ছিল। সেই শর্ত মেনেই শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ওইসব কলেজে চালু করা হয় অনার্স কোর্স।

কিন্তু গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ ধরার পর ১৭ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বন্ধ রয়েছে। ফলে বেসরকারি কলেজগুলো শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। এ অবস্থায় সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শন দপ্তর দেশের প্রায় ৩৫০ বেসরকারি কলেজকে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার নির্দেশ দেয়। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। ওই নোটিশ পাওয়ার পর বেতন পাওয়ার চিন্তা তো দূরের কথা, বরং চাকরিটা থাকবে কি না- তা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন শিক্ষকরা। কারণ তাদের বেতন দিতে না পারায় যদি কলেজগুলোর অধিভুক্তিই বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো শিক্ষকদের চাকরিটাই থাকবে না।

education ministry 2019শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ফাইল ছবি

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, কলেজগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে শিক্ষকদের বেতন নিশ্চিত করা হয়। যেসব কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বেতন দেবে না, সেগুলোর অধিভুক্তি বাতিল করা হবে। এ ব্যাপারে মনিটরিং (পর্যবেক্ষণ) করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) ২০১৪ সালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশনার আলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে অনার্স-মাস্টার্স স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আগে শিক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মতামত চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিগত ৭ বছরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। অবশ্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে ২০১৬ সালে এবং গত বছর করোনার মহামারি শুরুর পর শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার জন্য চিঠি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ নতুন করে চিঠি দেওয়া হয় গত ১৩ জুন। এতে বলা হয়, অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের বেতন দিতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের অধিভুক্তি বাতিল করবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে এক শিক্ষক বলছেন, এর আগে বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তর বাতিল করার আলোচনা উঠেছে। সেটা নিয়েই চাকরি হারানোর শঙ্কায় আছি আমরা। তার ওপর এখন আবার নতুন করে যোগ হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ওই নোটিশ। এতে কলেজ কর্তৃপক্ষের হয়তো কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু চাকরি নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন আমার মতো অনেক শিক্ষক।

বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক হারুন-অর-রশিদ এ বিষয়ে বলেন, গত ১৩ জুন শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বেতনের দাবি করে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই দিনই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে একটি নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু এই নোটিশের পর থেকে বেতন তো দূরের কথা, উল্টো শিক্ষকরা নিজেদের চাকরি নিয়ে আতঙ্কে আছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিগৃহীত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিল্টন মণ্ডল বলছেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ বিগত ২৯ বছর ধরে কোনো বেতন-ভাতা দেয়নি। কেবল নামমাত্র কিছু সম্মানী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনাকালে সেটিও বন্ধ রয়েছে। বেতনের দাবিতে দীর্ঘ দিন আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া কিংবা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয় কর্তৃপক্ষও। এই প্রথমবারের মতো ‘শক্ত পদক্ষেপ’ হিসেবে নোটিশ দেওয়া হলো। কিন্তু সেটি বেতন-ভাতার নিশ্চিয়তার পরিবর্তে বরং শিক্ষকদের চাকরিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

তার মতে, অধিভুক্তি বাতিলের এই ভয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বেতন দেবে না। বরং সম্মান বাঁচাতে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে উল্টো শিক্ষকদেরই বেতন চাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এর আগে বেশিরভাগ কলেজ ইচ্ছা করেই বেতন দেয়নি। আর এখন যেখানে করোনার কারণে টিউশন ফি আদায় বন্ধ রয়েছে সেখানে কলেজগুলো অনার্স-মাস্টার্স স্তরের অধিভুক্তি রক্ষার জন্য শিক্ষকদের বেতন দেবে বলে মনে হয় না। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নোটিশ বরং শিক্ষকদেরই আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

উল্লেখ্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৯৩ সালে বেসরকারি স্কুল-কলেজ জনবল কাঠামো অনুযায়ী ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত এমপিওভুক্ত কলেজে অনার্স-মাস্টার্সের অনুমোদন দেয়। বিধি অনুযায়ী, কলেজগুলো নির্ধারিত স্কেলে শিক্ষকদের মূল বেতন দেওয়ার শর্তেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের টিউশন ফি থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আজ কলেজগুলোর জনবল কাঠামোতে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ স্থান পায়নি। এ কারণে সরকারি বিধিবিধানের আলোকে এসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন। আর তাই বিগত ২৯ বছর ধরে নিজেদের বেতন-ভাতা নিশ্চিতের আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষকরা।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.