কাবুলের স্পষ্টবাদী অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করল তালেবান

আফগানিস্তানের তালেবান সরকার কাবুলের একজন স্পষ্টবাদী সমালোচককে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ফয়জুল্লাহ জালাল কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তিনি আফগানিস্তানের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ড. মাসুদা জালালের স্বামী। সাবেক রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের অধীনে ড. মাসুদা জালাল মহিলাবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

অধ্যাপক ফয়জুল্লাহ জালাল

তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, অধ্যাপক জালালের বিরুদ্ধে জনগণকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া এবং মানুষের সম্মান নিয়ে খেলা করার অভিযোগ রয়েছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি অধ্যাপক জালালের টুইটার অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশটও শেয়ার করেছেন।

টুইটে অধ্যাপক জালাল লিখেছেন, তাকে বাড়ি থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও অধ্যাপক জালালের দাবি, টুইটার অ্যাকাউন্টটি তার নয়, ভুয়া অ্যাকাউন্ট। এই অ্যাকাউন্ট থেকে আজেবাজে বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বাবার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন অধ্যাপক জালালের মেয়ে হাসিনা জালাল। অবিলম্বে বাবার মুক্তির বিষয়টি সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।

আফগান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা অধ্যাপকের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং তালেবান সরকারের কাছে তাকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই গ্রেপ্তারের নিন্দা করেছে। সংস্থাটি বলেছে, তালেবানের উচিত অবিলম্বে তাকে ‌নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া।

মানবাধিকার কর্মী এবং কনফ্লিক্ট অ্যানালাইসিস নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক হোরিয়া মোসাদিক লিখেছেন, অধ্যাপক জালাল সত্য কথা বলা ছাড়া আর কিছুই করেননি। তালেবানরা ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন ও হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক জালাল আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অভিজাতদের সমালোচনা করেছেন এবং প্রকাশ্যে তাদের নিয়ে অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করেছেন। এমনকি গত বছরের আগস্টে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার আগেও তিনি রাজনীতিকদের সমালোচনা করেছিলেন।

অধ্যাপক জালাল সম্প্রতি একটি টিভি সাক্ষাৎকারে তালেবান শাসনের নিন্দা করেছেন। সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় এক তালেবান কর্মকর্তা সামনেই ছিলেন। তিনি তালেবান শাসন পদ্ধতির সমালোচনা করেন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেন। তার দাবি, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শর্ত অবশ্যই তালেবানকে পূরণ করতে হবে।

অস্ট্রিয়ান-আফগান সাংবাদিক এবং লেখক এমরান ফিরোজ বলেছেন, অধ্যাপক জালাল সঙ্গত কারণেই তালেবানের কঠোর সমালোচনা করেছেন। যেমনটি তিনি আগের শাসনামলেও করেছিলেন। এখন তিনি তালেবানদের হাতে বন্দি। যারা বাকস্বাধীনতার বিষয়ে চিন্তা করেন, তাদের মুক্তির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত তালেবানকে চাপ দেওয়া।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর আরেক আফগান সাংবাদিক মুজিব মাশাল বলেছেন, প্রফেসর জালাল তাদের একজন, যারা কারজাই এবং ঘানি সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে স্পষ্ট এবং সোচ্চার ছিলেন। তিনি কখনোই কথার এদিক-ওদিক করেননি। তার গ্রেপ্তার তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে।

লেখক এবং মানবাধিকাকর্মী নিলোফার সখী লিখেছেন, অধ্যাপক জালালকে গ্রেপ্তার করা তালেবানের নৃশংসতার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত, যা বাকস্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এ ঘটনা আফগান সমাজের বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল ব্যক্তিদের হৃদয়ে ভয় জাগিয়ে তুলেছে।

তালেবান প্রথমে আফগানিস্তানের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, তাদের অধিকার শরিয়া অনুযায়ী সুরক্ষিত হবে। তবে আফগানিস্তানের স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক প্রধান শাহারজাদ আকবর বলেছেন, তালেবানরা তাদের প্রতিশ্রুতি মানছে না। শান্তি আলোচনার সময় নারী অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মানের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা, কিন্তু সেটা রক্ষা করছে না।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সহযোগী এশিয়া পরিচালক প্যাট্রিসিয়া গসম্যান বলেছেন, ‘তালেবানের বিশ্বে আপনার অভিযোগ বা সমালোচনা করার কোনো অধিকার নেই। অধ্যাপক জালালের গ্রেপ্তার তালেবার সরকারের স্বীকৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলে আসছে, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র এবং মানব ও নারী অধিকারের প্রতি সম্মান তালেবান সরকারের স্বীকৃতির জন্য মৌলিক শর্ত।