আদালতের পর্যবেক্ষণ: সিনহা হত্যা পরিকল্পিত

বহুল আলোচিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আজ সোমবার কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালত রায় ঘোষণা করেন। এর আগে আদালতে ৩০০ পৃষ্ঠার রায় উপস্থাপন করা হয়। এ সময় পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আদালত।

সিনহা মো. রাশেদ খান, ফাইল ছবি

তাতে মামলাটির বিভিন্ন দিক ও খুঁটিনাটি বিষয় আমলে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, প্রথমে এপিবিএনের ৩ সদস্য মেজর সিনহার গাড়িটি আটকানোর পর ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে গাড়িটি পুনরায় আটকায় পুলিশ এবং ১০-২০ মিনিটের মধ্যে গুলি করা হয় তাকে। এতে সিনহা হত্যা পরিকল্পিত, এটা প্রমাণিত হয়।

বিচারকের পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়েছে, সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতের সাক্ষ্যে লিয়াকত আলীর ৪ রাউন্ড গুলি করার তথ্য মিলেছে। সিনহার হাতে পিস্তল আছে ভেবে গুলি করার কথা স্বীকার করেছেন লিয়াকত। সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন ওসি প্রদীপ, সেটি লিয়াকতের জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে। শেষ মুহূর্তেও ঘটনাস্থলে পৌঁছে সিনহার বামদিকে লাথি মারেন ওসি প্রদীপ, নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি।

সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী, ফাইল ছবি

এ ছাড়া জবানবন্দিতে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত বলেন, আগেই সিনহার গাড়িটি থামাতে বলেছিলেন লিয়াকত, সে অনুযায়ী গাড়ি থামানো হয়। পরে দুই হাত উঁচু করে সামনে ঝুঁকে থাকা অবস্থায় তাকে ৪ রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত। প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে ‘অনেক কষ্টের পর তোকে পেয়েছি’ বলে বুকে বামপাশে লাথি মারলে নিস্তেজ হয়ে যান সিনহা। ওসি প্রদীপের নির্দেশ মতো তারা কাজ করেছে, উল্লেখ করা হয় বিচারকের পর্যবেক্ষণে।

বিকেল নাগাদ রায় ঘোষণা করা হয়, তাতে প্রদীপ ‍ও লিয়াকতের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন আদালত। এর আগে দুপুরে পৌনে ২টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সিনহা হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি ওসি প্রদীপসহ মামলার ১৫ আসামিকে আদালতে আনা হয়। গত ১২ জানুয়ারি উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্ক শেষে আদালত রায় ঘোষণার জন্য ৩১ জানুয়ারি, আজ, দিন নির্ধারণ করেন।

মামলায় অভিযুক্তরা হলেন— টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ও বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী, প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক, এসআই, নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপ-পরিদর্শক, এএসআই লিটন মিয়া ও বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব।

এ ছাড়াও রয়েছেন- বরখাস্ত এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক, এসআই, মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন এবং আয়াজ উদ্দিন। এর মধ্যে দুই জনের মৃত্যুদণ্ড, ৬ জনের যাবজ্জীবন এবং ৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়।

এদিকে, রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটতে না পারে সেজন্য আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে স্থানীয় প্রশাসন। জেলা পুলিশের কয়েক শ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

এর আগে আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা ৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। সংবাদ মাধ্যমকে এ তথ্য জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি ফরিদুল আলম টিপু। আদালতের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, দুপুর ২টায় রায় ঘোষণা করা হবে। এর আগে পিপি ফরিদুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় রায় ঘোষণা করা হতে পারে। রায় ঘোষণা করবেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। 

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে গাড়ি তল্লাশিকে কেন্দ্র করে বিতণ্ডার এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। পরে গত ৫ আগস্ট নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলায় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ, পরিদর্শক, লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি করা হয়। এছাড়া টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করার জন্য র‌্যাবকে আদেশ দেন আদালত। প্রধান আসামি লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশসহ ৭ পুলিশ সদস্য গত ৬ আগস্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম সে বছরের ১৩ ডিসেম্বর প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলার অন্যতম অভিযুক্ত প্রদীপ কুমারের অন্যতম সহযোগী কনস্টেবল সাগর দেব ঘটনার শুরু থেকেই পলাতক ছিলেন। অবশেষে গত বছরের ২৪ জুন আত্মসমর্পণ করেন তিনি।