খাঁচায় বন্দি লাখ টাকার মোরগ, লক্ষ্য যুদ্ধ জয়!

মোরগ-মুরগী বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে একটি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার। সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষ যখন পশুর মাংস খাওয়া শুরু করেছে, তখন থেকেই মুরগী রয়েছে মানুষের খাদ্য তালিকায়।

লড়াকু মোরগ

এসব খাদ্যের যোগানদাতা জীব-জন্তুকে মানুষেরা শুধু খাবারের তালিকাতেই রাখে নাই। বরং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কিছু কিছু প্রাণীকে মানুষ বিনোদনের জন্যও ব্যবহার করতে শিখেছে। তাই তো বিষাক্ত সাপকেও বশ করে কৌশলে সাপের খেলা দেখায় সাপুড়ে। বিশাল বিশাল দেহের হাতির পিঠে বসেও হাতিকে দিয়ে কৌশলে খেলা দেখিয়ে বিনোদন দিতে শিখে গেছে মানুষ।

তেমনি মোরগকেও ট্রেনিং দিয়ে নিজেদের আয়ত্বে এনে "মোরগ লড়াই " খেলার আয়োজন করে মানুষ। এই খেলাটি বহু বছর আগেই শিখে ফেলেছে মানবজাতি। বর্তমানে কম্বোডিয়ার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী খেলা এই " মোরগ লড়াই "। সাধারণত বিভিন্ন উৎসবে এই খেলার আয়োজন করা হয়।

লড়াকু মোরগ

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে টিপু সুলতান, সম্রাট আকবরসহ অনেক রাজাও শখ করে বড় বড় মোরগ পুষতেন। এরপর এসব মোরগের মধ্যে লড়াই দেখতেন। এই লড়াই দেখাটাকে বিনোদনের একটা অংশ হিসেবে নিতেন তারা। বাংলাদেশের এক সময়ের অতি পরিচিত এই খেলাকে ককফাইট বা মোরগ লড়াই বলা হয়। অনেকে এটাকে ‘আসিল মোরগ লড়াই নামেও " চিনে।

কিন্তু এই খেলাটি বাংলাদেশে এখন আর তেমন দেখা না যায় না, যদিও তুরস্কের জাতীয় খেলা কিন্তু এই মোরগ লড়াই। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, জাপানসহ বহু দেশে এই খেলার প্রচলন রয়েছে এখনো।

তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশে এখন কিছু ক্লাব গড়ে উঠেছে মোরগ লড়াইয়ের জন্য। যেমন শৌখিন আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, আরসিডি মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, রয়েল আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ক্লাব রয়েছে।

এসব ক্লাবের মোরগের মালিকেরা বিভিন্ন এলাকায় মোড়গ লড়াইয়ে জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেলায় বা বার্ষিক কোনো বিশেষ দিনে আয়োজন হয় মোরগ লড়াইয়ের।

এমনি একটি মোরগ ক্লাবের সভাপতি ও মালিক সেলিম আহমেদ। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরেই তার বসবাস। সেখানেই তার বাড়ির পাশের সড়কে দেখা মেলে বড় বড় মোরগ খাঁচায় রেখে খাবার খাওয়াচ্ছিলেন এবং যত্ন নিচ্ছিলেন তিনি। ওখানে কথা হয় তার সাথে।

তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমার একটি ক্লাব রয়েছে। নাম "ঈশা খাঁ আসিল ফাইট ক্লাব"। আমি এই ক্লাবের সভাপতি। প্রত্যেক বছর মেলাতে এই মোরগ দিয়ে মোরগ লড়াই খেলায় অংশ গ্রহণ করি আমি। তিনি আরও বলেন, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট অঞ্চলে এই মোরগ লড়াই খেলা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় বড় মোরগের ক্লাবগুলোও এই খেলার আয়োজন করে।

এই লড়াকু বা ফাইটার মোরগগুলোর দাম কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব মোরগের দাম ৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৭০ বা ৮০ হাজার টাকা, অনেক সময় এক লাখ টাকাও হয় একেকটা মোরগের দাম। এ পর্যন্ত আপনার মোরগ নিয়ে কতটি খেলায় অংশ নিয়েছেন এবং জিতেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, " প্রায় শতাধিক খেলায় অংশ নিছি। আমি এখন পর্যন্ত কোনো মোরগ লড়াইয়ে হারি নাই।"

এই ফাইটার মোরগ কী ধরনের খাবার খায়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধান, গম, ভুট্টাসহ অনেক কিছু খাওয়াতে হয়।মোরগগুলো খাঁচায় কেন রেখেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এগুলো ফাইটার মোরগ। তাই খাঁচার বাইরে রাখলেই অন্য মোরগ, মুরগীর সাথে ফাইট লেগে যায়। তখন দেখা যায়, একটা আরেকটারে মাইরা ফেলবে। সে কারণে খাঁচায় রাখা হয় বেশির ভাগ সময়। আর খাঁচার বাইরে যেগুলো থাকে সেগুলো মুরগী। সেগুলো ডিম দেয়, ওরা ফাইট করতে পারে না।

আপনার কতটি ফাইটার মোরগ রয়েছে আর এসব মোরগ অন্য মুরগীর মতো অসুস্থ হয় কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন আমার কাছে ফাইট করার মতো ১১টা মোরগ প্রস্তুত করা আছে। ২ বছর আগে একসাথে আমার ১৪টা মোরগ মারা গেছে, রানীক্ষেত রোগে। যদিও আমি নিয়মিত মোরগ-মুরগীকে সকল ভ্যাকসিন দেই। তখন বিশাল বড় এক ক্ষতির মধ্যে পড়েছিলাম।

ফাইট করার জন্য এসব মোরাগ কোথায় থেকে সংগ্রহ করেন? উত্তরে তিনি বলেন, "আমার কাছে ফাইটার মোরগের যে জাতটা রয়েছে সেগুলো ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে আনা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে হায়দ্রাবাদী মোরগ।

লড়াইয়ের জন্য মোরগগুলোকে প্রশিক্ষণ কীভাবে দেয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে যখন লড়াইয়ের জন্য মোরগদের ট্রেনিং করাই। তখন তাদের ভালো-মন্দ খাবার খাওয়াতে হয়। এরপর রেসলিংয়ের মতো নিজের হাতে ট্রেনিং দিতে হয়। এছাড়াও ট্রেনিংয়ের সময় বা লড়াইয়ের মাঠে যাওয়ার আগে মোরগকে অনেক দামি দামি খাবার খাওয়াই। যেমন, কাঠ বাদাম, পেস্তা বাদাম, কাজু বাদাম।

লড়াকু মোরগ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী- এমন কথার উত্তরে তিনি বলেন, "আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো- আমি কিশোরগঞ্জ জেলাকে মোরগ লড়াইয়ের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত করতে চাই। এটাই আমার মূল লক্ষ্য। ব্যবসায়ীক কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার। মানুষ কিশোরগঞ্জটাকে চিনবে, আমাকে চিনবে- এটাই আমার চাওয়া। মোরগ লড়াই খেলাটা যেন যুগ যুগ ধরে টিকে থাকে বাংলাদেশে।"