রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং যেভাবে ভোল পাল্টাচ্ছে তারা
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর রুশ ধনকুবেররা আছেন তোপের মুখে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো একের পর এক রুশ ধনকুবেরের সম্পদ জব্দ করছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত এসব ধনুকবের ছাড়াও বিপাকে পড়েছে পশ্চিমা দুনিয়ার নামী ব্যাংক, সম্পদ ব্যবস্থাপক, অ্যাকাউন্টিং ও জনসংযোগ কোম্পানিগুলো। কারণ এতদিন ধরে ধনকুবেরদের সম্পদ ও সুনামের পাহারাদার হিসেবে কাজ করেছে এসব প্রতিষ্ঠান। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুব ধ্রুত ভোল পাল্টে সামলে নিচ্ছে তারা।
বাইডেন, পুতিন এবং জেলেনস্কি
শুধু রাশিয়া নয়, তাবৎ দুনিয়ার ধনকুবেরদের সম্পদ আগলে রাখে, গোপন রাখে পাশ্চাত্যের অভিজাত ব্যাংক, অ্যাকাউন্টিং ও পিআর ফার্মগুলো। ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর হন্যে হয়ে গা থেকে রাশিয়ার ছাপ মুছে ফেলতে চাইছেন আমেরিকা, ইউরোপের এলিট আইনজীবী, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ইমেজ ম্যানেজাররা।
যেমন, রাশিয়ান ওয়েলথ অ্যাডভাইজার ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটি নিজের পরিচয় দেয় রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর আল্ট্রা হাই নেট ওয়ার্থ ইনডিভাইজুয়াল বা অতি ধনী ব্যক্তিদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করা বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞদের প্রধান সাক্ষাৎস্থল হিসেবে। এই ফোরামের চলতি বছরের সমাবেশ হবার কথা মে মাসে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। এজেন্ডা ছিল, রাশিয়ার সুপার-রিচ বা অতি ধনীদের সম্পদ কিভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়।
মে মাসের সমাবেশকে সামনে রেখে রাশিয়ান ওয়েলথ অ্যাডভাইজার ফোরাম একটি ওয়েবসাইট খুলেছে। এতে লেখা- ‘‘সম্পদশালীদের জন্য পৃথিবী এক সমস্যাসঙ্কুল জায়গা হয়ে উঠেছে। সরকারগুলো অর্থের জন্য কাঙাল, বুভুক্ষু হয়ে পড়েছে। কে কিসের মালিক, কার সম্পদ কোথায় রয়েছে, এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে নানা জায়গায়। ধনীরা রয়েছে পাদপ্রদীপের আলোয়, যেখানে প্রায় সময়ই তারা টার্গেটে পরিণত হচ্ছে।’’
রাশিয়ান ওয়েলথ অ্যাডভাইজার ফোরামের আসন্ন সমাবেশে যেসব নিবন্ধ উপস্থাপনের কথা রয়েছে তার কয়েকটির শিরোনাম- ‘প্যান্ডোরা পেপারস এবং ধনীদের উপর এসব নথিপত্রের প্রভাব’, ‘ট্যাক্স অ্যান্ড ইমিগ্রেশন’, ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি কি ব্যাংকেবল এসেট?’। প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস, আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ুং, মিশন দো রিয়ার মতো শীর্ষস্থানীয় অ্যাকাউন্টিং ও লিগ্যাল ফার্মের হর্তাকর্তারা এসব নিবন্ধ উপস্থাপন করার কথা।
এদিকে মজার ব্যপার হলো, রাশিয়ান ওয়েলথ অ্যাডভাইজার ফোরাম বৃহষ্পতিবার থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এ নিয়ে অনুসন্ধানের জবাবে মে মাসের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এক ইমেইলে লিখেছে- ‘‘আমরা বর্তমানে রাশিয়ার বাজার থেকে বেরোনোর প্রক্রিয়ায় রয়েছি। সবকটি রাশিয়ান ইভেন্ট নতুন মালিকের হাতে হস্তান্তর করা হচ্ছে।’’
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোন ‘নতুন মালিক’ এমন ইভেন্টের দায়িত্ব নিবে, সেটা বোধগম্য নয়। নতুন চুক্তি ও বিনিয়োগ কৌশল নয়, বরং গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে নিজেদের লিকুইড এসেট যেমন নগদ অর্থ, বন্ড, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ট্রেজারি বিল, ডিপোজিট সার্টিফিকেট, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) ইত্যাদি সরিয়ে নিতে শশব্যস্ত রাশিয়ার মিলিওনেয়ার ও বিলিওনেয়াররা। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং সীমিত মাত্রায় হলেও যুক্তরাজ্য থেকে যে নিষেধাজ্ঞার ঢল নেমেছে সেটা এড়িয়ে গা বাঁচিয়ে অন্যত্র সটকে পড়াই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বুধবার টাস্কফোর্স ক্লেপটোক্যাপচার নামে নতুন এক সংস্থা গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। পুতিনের আমলে ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে ওঠা রুশ ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ শনাক্ত ও জব্দ করাই এ সংস্থার মিশন। টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল লিসা মোনাকো বলেন- ‘‘ধনকুবেররা হুঁশিয়ার। আপনাদের অপরাধলব্ধ সম্পদ জব্দ ও বাজেয়াপ্ত করতে আমরা সব কৌশল অনুসরণ করব।’’
রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে কয়েক ডজন নিষেধাজ্ঞা এরইমধ্যে জারি হয়েছে। নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আসবে। বিদ্যমান ও আসন্ন নিষেধাজ্ঞাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ব্যবসা ও ভাবমুর্তির ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে পাশ্চাত্যের ব্যাংক, লিগ্যাল ফার্ম ও পিআর এজেন্সিগুলো রাশিয়ার বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কমাতে তোড়েজোড়ে নেমেছে। গত এক সপ্তাহে জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো লন্ডন নিউইয়র্কের প্রফেশনাল সার্ভিস সেক্টরের অনেক কনসালট্যান্ট, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, পিআর ফার্ম ও আইনজীবীর জন্য বিপদ হয়ে এসেছে।
লন্ডনের কথাই ধরা যাক। বিত্তশালী মক্কেলদের সম্পর্কে সংবাদ ছাপলেই সাংবাদিকদের মানহানি মামলা দিয়ে হয়রানি করানোর আগ্রহ ও দক্ষতার কারণে বহির্বিশ্বে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে লন্ডনের ডিফেমেশন লইয়াররা। এবার তারা ভোল পাল্টাচ্ছে। গত কয়েকদিনে বেশকিছু আইনী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা আর পুতিনপন্থী মক্কেলদের মামলা নিচ্ছে না।
ল ফার্ম কার্টার-রাক তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে বলেছে, নিষেধাজ্ঞা চ্যালেঞ্জ, বাতিল ও সঙ্কুচিত করতে আগ্রহী কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তারা কাজ করছে না, অতীতেও করেনি। কার্টার-রাক পুতিন প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-কোম্পানির পক্ষে কাজ করছে না, ভবিষ্যতেও করবে না।
আরেক প্রতিষ্ঠান শিলিংস বলেছে, নিষেধাজ্ঞা ওঠাতে অথবা অন্য কোনো লক্ষ্যে আমরা নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছি না। আমরা আশা করছি, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ইউক্রেনে পুতিনের জঘন্য যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হবে।
মানহানির মামলা রুজুর জন্য পরিচিতি পাওয়া আরেক আইনী প্রতিষ্ঠান হারবটল অ্যান্ড লিউয়িস বলেছে, নিষেধাজ্ঞাভূক্ত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান কারও পক্ষে আমরা কাজ করছি না এবং কোনো নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গেও দেনদরবার করছি না।
আরেকটি ল ফার্ম মিশন দো রিয়ার পার্টনারদের একজন রাশিয়ান ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট ফ্রোামে নিবন্ধ উপস্থাপনের জন্য তালিকাভূক্ত হয়েছিলেন। এ নিয়ে জানতে চাইলে মিশন দো রিয়ার মুখপাত্র বলেন, সমাবেশটি বাতিল না হয়ে থাকলে তিনি নাম প্রত্যাহার করবেন।
ব্রিটেনের পাবলিক রিলেশন ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাও একই। পুতিন প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে কাজ করলে তার জন্য মূল্য দিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ব্রিটেন সরকার। পিআর প্রতিষ্ঠানগুলোও তাই গা থেকে রাশিয়ার গন্ধ মুছতে উঠেপড়ে লেগেছে।
এফটিআই কনসালটিংয়ের এক মুখপাত্র বলেন, নিষেধাজ্ঞাভূক্ত গ্রাহকদের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। এখনো নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন নন, এমন রুশ গ্রহাকদের সঙ্গে সম্পর্কও আমরা পুনর্বিবেচনা করছি। যাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল সম্ভব, আমরা তা করবো। এছাড়া নতুন করে কোনো রুশ গ্রাহক আমরা নিচ্ছি না।
রুশ ধনকুবের ওলেগ দেরিপাস্কার মালিকানাধীন এলুমিনিয়াম কোম্পানি ইএন প্লাসের হয়ে জনসংযোগ সেবা দেয় ব্রিটিশ পিআর ফার্ম কামারকো। ইএন প্লাসের সঙ্গে এখনো চুক্তি আছে কিনা জানতে চাইলে কামারকোর এক মুখপাত্র বলেন, আমরা পদত্যাগ করেছি।
পিআর ফার্ম হাডসন স্যান্ডলারের ম্যানেজিং পার্টনার অ্যান্ড্রু হায়েস বলেন, ইউক্রেনে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রাশিয়ায় সব ব্যবসা বন্ধ করছি।
অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোও একই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ খাতের চারটি বড় প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস (পিডব্লিউসি), আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ুং (ইওয়াই), ডেলয়েট ও কেপিএমজি। চার প্রতিষ্ঠানের মোট ১৩ হাজার কর্মী রয়েছে রাশিয়ায়। রাশিয়ার প্রথম সারির সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্ট ও ব্যালেন্স শিপ অডিট কওে এসব প্রতিষ্ঠান।
নামকরা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সচরাচর তাদের দেশওয়ারি আয়ের তথ্য প্রকাশ করে না। তবে ২০১৯ সালে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ুং জানিয়েছিল, সে বছর রাশিয়ায় তারা ৬০০ কোটি রুবলের বেশি (৪ কোটি ১০ লাখ পাউন্ড) আয় করে।
পিডব্লিউসির এক মুখপাত্র বলেছেন, তারা ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন। ইওয়াই জানিয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধিনিষেধগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কেপিএমজির প্রধান নির্বাহী জোনাথন হল্ট লিঙ্কডইনে এক স্ট্যাটাসে রুশ অভিযানে যাদের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, রাশিয়ায় কার্যক্রম বন্ধ করার কোনো ধরনের ঘোষণা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আসেনি। তবে বিগ ফোর নামে পরিচিত এই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘনিষ্ট একটি সুত্র পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেছে, রাশিয়ায় পুতিন সরকারের খড়গহস্ত এড়াতে তারা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দায়সারা বিবৃতি দিচ্ছেন।
একটি কোম্পানির পদস্থ এক নির্বাহী বলেছেন, রাশিয়ায় স্থানীয় কর্মীদের উপর পুতিন সরকারের নিপীড়নের ঝুঁকি এড়াতে তাদের কৌশলী হতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দৃশ্যপটের আড়ালে প্রচুর তৎপরতা চলছে। বিদ্যমান স্থিতাবস্থায় আস্থা রাখার জো নেই।
এটাই আসল কথা। পর্দার আড়ালে জোর তৎপরতা চলছে সম্পদ স্থানান্তরের, সম্পদ আড়ালের।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.