৭ মার্চের ভাষণ: মুক্তির সনদ থেকে যেভাবে বৈশ্বিক সম্পদ

‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণের একটি অংশ ছিল এটি। এরপর এ অংশটি গত ৫০ বছরে লাখো-কোটিবার উচ্চারিত হয়েছে বাঙালির মুখে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এখন বৈশ্বিক সম্পদ

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। তবে এখন সেটি শুধু বাঙালির সম্পদ নয়, বৈশ্বিক সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর কালজয়ী এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনাইটেড নেশান্স এডুকেশন, সাইন্স অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন, ইউনেস্কো।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য গৌরব ও আনন্দের। এ স্বীকৃতির ফলে কালোত্তীর্ণ ভাষণটি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ন্যায় ও মুক্তির পথে এগিয়ে চলতে উজ্জীবিত করবে।

৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রথম প্রচেষ্টা নেয়া হয় ২০০৯ সালে। ইউনেস্কোর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনার ও কর্মশালায় এই ভাষণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সুদূরপ্রসারী প্রভাব, মর্মার্থ ও তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত এক কর্মশালায় ভাষণটির ওপর একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের (বিএনসিইউ) তৎকালীন প্রোগ্রাম অফিসার ও শিক্ষাবিদ রোকেয়া খাতুন।

সরকারের সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক হিসেবে ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ২০১৫ সালে ইউনেস্কোতে প্রস্তাব পাঠান। একই সময়ে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খানও ইউনেস্কোতে আলাদা প্রস্তাব পাঠান। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, তথ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোর স্থায়ী প্রতিনিধি শহীদুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত শহিদুল ইসলাম ইউনেস্কোতে ভাষণটির বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেন।

ইউনেস্কোতে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)। শহিদুল ইসলামের আবেদনের পর ২০১৭ সালের ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বৈঠক করে ১৫ বিশেষজ্ঞের এই কমিটি। তারা ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে সংস্থাটির তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী তথ্যচিত্রের তালিকা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্তের ঘোষণা দেন। অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় (ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) মোট ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেয়। এ তালিকায় ৪৮ নম্বরে ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।

মূলত মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে এমন বিষয়গুলোকেই তালিকাভুক্ত করা হয়। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব থাকতে হয়। এ সংক্রান্ত তালিকাভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)।

১৯৯২ সালে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম চালু করে ইউনেস্কো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দালিলিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সচেতনতার তাগিদে এটি চালু হয়। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা। ভাষণটি পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভাষণ হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে অনেক আগেই।