ছোট হয়ে আসছে রাশিয়ার আকাশ

ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে রাশিয়ার আকাশ। ইউক্রেন অভিযানের জেরে রুশ নাগরিকদের আন্তর্জাতিক বিমান ভ্রমণের সুযোগ অনেকটাই নেই হয়ে গেছে। রাশিয়ার বিমান চলাচল খাতের উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার ফলে বন্ধুভাবাপন্ন দেশেও রুশদের বিমান ভ্রমণের সুযোগ সঙ্কুচিত হতে চলেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে উত্তর কোরীয়দের মতো রুশদের জন্যও বিমান ভ্রমণ অধরা হয়ে পড়ছে।

বন্ধুভাবাপন্ন দেশেও রুশদের বিমান ভ্রমণের সুযোগ সঙ্কুচিত হতে চলেছে

ইউক্রেন অভিযানের ১০ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের আকাশে অ্যারোফ্লত ও অন্যান্য রুশ এয়ারলাইন্স নিষিদ্ধ হয়েছে। উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রধান দুটি কোম্পানি বোয়িং ও এয়ারবাস রাশিয়ায় তাদের সেবা বন্ধ করেছে। বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে উড়োজাহাজ লিজদাতা সংস্থাগুলো রাশিয়ায় সেবা দিতে পারছে না। এতে করে নিজেদের কাছে থাকা উড়োজাহাজগুলোও রুশরা ব্যবহার করতে পারছে না। অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সহযোগিতার পথও বন্ধ।

ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশের তালিকায় এরইমধ্যে ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে রাশিয়া। নতুন করে ২ হাজার ৭৭৮টি নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে দেশটি। নিষেধাজ্ঞা ও ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ট্র্যাকিং ডাটাবেজ ক্যাস্টেলাম এআই’র তথ্য মতে, রাশিয়ার উপর মোট নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা এখন ৫ হাজার ৫৩০।

বোয়িং

এভিয়েশন খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার এভিয়েশন খাতের উপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষেধাজ্ঞা জাল যেভাবে বিস্তুৃত হয়েছে তাতে রুশ নাগরিকদের জন্য উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে বিমান ভ্রমণের পথ বন্ধ। ভবিষ্যতে কখন তারা আবার এ সুযোগ পাবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। এমনকি চীনের মতো বন্ধুভাবাপন্ন দেশেও রুশদের বিমান ভ্রমণের সুযোগ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

মিশিগানভিত্তিক কোম্পানি অ্যারোডাইনামিক অ্যাডভাইজরি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিচার্ড আবুলালফিয়া ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, বিমান খাতের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবত করা সহজ। রাশিয়া হতে চলেছে এমন দেশ যাদের অর্থনীতি উন্নত, কিন্তু এভিয়েশন খাত উত্তর কোরিয়ার মতো। রুশ এয়ারলাইন্সগুলো ডানা মেলতে পারছে না। তাদের এয়ারক্রাফট পরিকল্পনা পুরোপুরি নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। বিদ্যমান এয়ারক্রাফট প্ল্যানগুলো পশ্চিমা প্রযুুক্তিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের এয়ার ট্রাফিক এজেন্সি ইউরোকন্ট্রোলের তথ্য মতে, ইউরোপ অভিমুখে রুশ ক্যারিয়ারগুলোর দৈনিক ৩০০ ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে, রাশিয়ার পথে ইউরোপীয় ক্যারিয়ারগুলোর দৈনিক ৫০টি ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। রুশ ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে যে দেশগুলো, তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা একইরকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছে রাশিয়া।

অ্যারোস্পেস ও ডিফেন্স অ্যানালিস্ট কোম্পানি এজেন্সি পার্টনারসের বিশ্লেষক সাশ টুসা বলেন, রাশিয়ার নাগরিকদের জন্য বিমান ভ্রমণ দুটি কারণে ক্রমশ কঠিন হতে থাকবে। প্রথমত, পশ্চিমা উড়োজাহাজগুলোর জন্য রাশিয়ার আকাশসীমা বন্ধ। আবার পাশ্চাত্যে নির্মিত যেসব উড়োজাহাজ রাশিয়ার রয়েছে, সেগুলো সার্ভিসিংয়ের পথও বন্ধ।

এভিয়েশন অ্যানালিটিক্স কোম্পানি কিরিয়ামের তথ্য মতে, মার্কিন কোম্পানি বোয়িং ও ইউরোপীয় কোম্পানি এয়ারবাস উভয়েরই তিনশ’র বেশি উড়োজাহাজ রয়েছে রাশিয়ায়। সেদেশের এয়ারলাইন্সগুলোতে রাশিয়ায় নির্মিত উড়োজাহাজ মাত্র ১৩৬টি।

রাশিয়ায় প্রতি চারটি বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের মধ্যে তিনটিই বোয়িং অথবা এয়ারবাসের নির্মিত। দুটি কোম্পানিই রুশ এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে স্পেয়ার পার্টস বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। উপরন্তু, মার্কিন কোম্পানি বোয়িং মস্কোতে তাদের ডিজাইন সেন্টারটিও বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বোয়িংয়ের অফিসটিও সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এয়ারলাইন্সগুলোর স্পেয়ার পার্টস সরবরাহ শেষ হতে কয়েক মাস লাগতে পারে। এরপর কার্যক্রম চালাতে হলে কিছু উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডিং করে সেগুলোর যন্ত্রাংশ কেটে অন্যান্য উড়োজাহাজে সংযোজন করা যায়। যদিও বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ ইজারা চুক্তিতে এমন ক্যানিবালাইজিং নিষিদ্ধ।

রুশ এয়ারলাইন্সগুলোর বেশিরভাগ উড়োজাহাজের মালিক পাশ্চাত্যের বিভিন্ন লিজিং কোম্পানি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় লিজিং কোম্পানিগুলোকে রুশ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের জন্য ২৮ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী লিজিং কোম্পানিগুলো উড়োজাহাজ ফেরত চেয়ে রাশিয়ার বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছে।

তবে উড়োজাহাজ ফেরত পাওয়া অথবা দেয়া আদৌ সহজ হবে বলে মনে করছেন না খাত সংশ্লিষ্টরা। উড়োজাহাজ লিজিং খাতে নেতৃস্থানীয় কোম্পানি এয়ারক্যাপের একটি সুত্র বলেছে, এতো অল্প সময়ে শত শত উড়োজাহাজ ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। আরেক লিজিং কোম্পানি ওমেগা এয়ারের প্রতিষ্ঠাতা ইউলিক ম্যাকেভাডির ভাষায়, এটা মিশন ইম্পসিবল। প্রথমত, রাশিয়ানরা আইনি চ্যালেঞ্জ দাঁড় করাতে পারে। ইউরোপীয় আকাশসীমায় রুশ উড়োজাহাজ নিষিদ্ধ থাকাও একটি বাধা হিসেবে কাজ করবে।

এমন নয় যে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ হলেই রাশিয়ার এভিয়েশন খাত আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে। পাশ্চাত্যের চোখে রাশিয়া কতদিনে আস্থাভাজন হতে পারে, সেটাও একটা প্রশ্ন। সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি ড্রাগনফ্লাই’র প্রতিষ্ঠাতা হেনরি উইলকিনসন মনে করেন, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ রাশিয়ার এভিয়েশন খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর পথে বড় বাঁধা হবে। ইউরোপ থেকে এশিয়াগামী ফ্লাইটগুলো রাশিয়া ও ইউক্রেনের আকাশসীমা এড়িয়ে আরও দক্ষিণে তুরস্ক, ইরান ও আফগানিস্তানের উপর দিয়ে যাতায়াত করছে।

২০১৪ সালে রাশিয়ায় নির্মিত বিইউকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনের আকাশসীমায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হবার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাশিয়াকে আস্থার সংকটে ভীষণভাবে ভুগতে হবে। একই মত জানিয়ে এজেন্সি পার্টনারসের সাশ টুসা বলেন, যুদ্ধ বন্ধের পরও এভিয়েশন খাতে রাশিয়ার সঙ্গে পাশ্চাত্যের সহযোগিতা পুনরায় শুরু হতে বহু সময় লেগে যাবে।