রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা: ওলট-পালট হতে পারে সবকিছু

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জেরে বদলে যেতে চলেছে রুশ নাগরিকদের জীবন। খাবার থেকে শুরু করে পরিধেয়, সুগন্ধি, গেজেট, পানীয়, বিনোদন সহ দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুতেই পরিবর্তনের আঁচ পাবেন তারা। টয়োটা, হাইনিকেন, নাইকি, অ্যাপল, এক্সন, ফোর্ড, যারা, নেটফ্লিক্স, আইকিয়ার মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো রাশিয়া ছাড়ায় স্থানীয়দের জীবন যেন ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে স্নায়ুযুদ্ধের কালে ফিরতে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বেকারত্ব যোগ হয়ে ওলট-পালট হতে পারে সবকিছু।

বদলে যেতে চলেছে রুশ নাগরিকদের জীবন

১৯৯০ সালে যেদিন মস্কোর পুশকিন স্কয়ারে ম্যাকডোনাল্ডসের আউটলেট খোলা হয় সেদিন কয়েক হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন ফাস্টফুডের স্বাদ পেতে। রাশিয়ায় ম্যাকডোনাল্ডসের আগমনকে স্থানীয় ও বিদেশীরা দেখেছিলেন স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের লক্ষণ হিসেবে। পশ্চিমা ফাস্ট ফুড, পপ কালচার, জিন্সে রুশদের অভ্যস্ততাকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার সঙ্গে সখ্যতা ভাবা হতো। স্থানীয় মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির উত্থান দেখে একের পর এক দুয়ার খুলেছিল আন্তর্জাতিক ব্রান্ডগুলো। কিন্তু দুই সপ্তাহেই পুরো পাল্টে গেছে পরিস্থিতি।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ও লাইন দেখা গেছে পুশকিন স্কয়ারের ম্যাকডোনাল্ডসে। তার খানিকক্ষণ আগে রাশিয়ায় নিজেদের ৮৫০টি আউটলেট সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দেয় এ ফাস্টফুড জায়ান্ট। তবে যুদ্ধ, অবরোধ যা-ই হোক, রুশদের রসবোধ সহজে হারাবার নয়। যেমন বোঝা গেল ম্যাকডোনাল্ডসের বাইরে অপেক্ষমান দিমিত্রি গ্রিগরিয়েভের কথায়- ‘‘বাবার কাছে শুনেছি, ম্যাকডোনাল্ডস খোলার দিনে তিনি লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমিও লাইনে আছি, যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। কখনো কখনো ইতিহাস পরিহাসের হতে পারে।’’

২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর থেকে সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর রাশিয়া ছাড়ার হিড়িক পড়েছে। ফোর্ড, জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার, ভক্সওয়াগন, জেনারেল মটরস, হনো, টয়োটার মতো গাড়ি নির্মাতা, ক্লদিং রিটেইলার বুহু আসোস, এইচঅ্যান্ডএম, ম্যাঙ্গো, যারা, নাইকি, ফ্যাশন ব্র্যান্ড বেলেনসিয়াগ্গা, গান্নি, নানুশকা, বারবারি, গুচ্চি, আরমানি, শানেল, আরমেস, লুই ভিশন অথবা ট্রাভেল শপিং কোম্পানি এক্সপেডিয়া, কন্ডি নাস্ত, পানীয় প্রস্তুতকারক কোকাকোলা, ডিয়াজিও কে নেই যাবার তালিকায়!

আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ মারিয়া শাগিনার ভাষায়- ‘‘কোম্পানিগুলোর বেরোনোর ঢল অবাক করার মতো। যত দ্রুত ব্যাপারগুলো ঘটছে, তার নজির আধুনিক ইতিহাসে নেই। বৈশ্বিক বাণিজ্যিক, প্রাযুক্তি ও ব্যাংকিং সম্প্রদায় থেকে রাশিয়াকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।’’

ফিনিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ও জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল স্যাঙ্কশন্স নেটওয়ার্টের সঙ্গে কাজ করছেন মারিয়া শাগিনা। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দিবে, এটা নিশ্চয় ক্রেমলিনের কর্মকর্তাদের মাথায় ছিল। কিন্তু রাশিয়া এতো পরিত্যাজ্য হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা তাদের ছিল বলে আমার মনে হয় না। কোম্পানিগুলো কেবল নিষেধাজ্ঞার কারণে চলে যাচ্ছে, তা নয়। বরং তারা মনে করছে যে রাশিয়া এ মুহূর্তে বিনিয়োগের উপযোগী নয়।

রাশিয়া যে এতো নাটকীয় প্রতিক্রিয়া আশা করেনি সেটা বোঝা যায় ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির নেতা আন্দ্রেই তুরচাকের কথায়। রাশিয়া ছেড়ে যাওয়া কোম্পানিগুলোর স্থানীয় অপারেশন জাতীয়করণের প্রস্তাব দিয়ে পার্টি ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘‘তারা যা করছে তা চরমপন্থা। কিন্তু আমরা পেছন থেকে কারো ছুরিকাঘাত মেনে নিব না। আমরা নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষা দিব।’’

রাশিয়ায় জনপ্রিয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্লগার কাতিয়া ফেদোরোভা বলেন, ‘‘ আমার ধারণা বিদ্যুৎ গতিতে সবকিছু পাল্টে যেতে দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার কি ধরনের প্রভাব আগামী মাসগুলোতে সবার জীবনে পড়তে যাচ্ছে সে সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। লাক্সারি ব্র্যান্ডগুলোর যাওয়ার তেমন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু জন-সম্পৃক্ত ব্যান্ডগুলোর চলে যাওয়া খুব খারাপ খবর। ত্রিশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক রিটেইল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে রুশ সরকার যেভাবে ধ্বংস করল, সেটা নিছক পাগলামি।’’

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা রাশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দি ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স (আইআইএফ) রাশিয়ার চলতি বছরের জিডিপিতে ১৫ শতাংশ সঙ্কোচনের আভাস দিয়েছে। আইআইএফের মুখ্য অর্থনীতিবিদ রবিন ব্রুকস লিখেছেন- রাশিয়া আর আগের মতো হবে না।

ম্যাকডোনাল্ডস, আইকিয়াসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আপাতত রাশিয়ায় তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু মারিয়া শাগিনা মনে করছেন বিদেশি কোম্পানিগুলোর বহির্গমনের ঢল অচিরেই বেকারত্ব বাড়িয়ে দিবে। তিনি বলেন, ‘‘কেবল দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞার দাঁত বসতে সময় লাগে। নিষেধাজ্ঞার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এর সঙ্গে বেকারত্ব যোগ হলে সাধারণ মানুষের জীবন অনেকখানি পাল্টে যাবে। রাশিয়া হয়তো নব্বই দশকের মতো হয়ে যাবে, যেটা মোটেও স্থিতিশীল সময় ছিল না।’’

দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে