ভীষণ খাদ্য সংকটের মুখে বিশ্ব
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তিন সপ্তাহের মাথায় খাদ্য সংকটের ঘনঘটা শুনতে পাচ্ছে পৃথিবী। যুদ্ধরত দুই দেশ থেকে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর দামে নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে মোটামুটি সব অঞ্চলে সার উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এতে করে আরেক দফা ব্যাহত হবে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ। সবমিলিয়ে ভীষণ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ।
ভীষণ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রীতিমতো অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম শুক্রবার প্রতি ব্যারেল ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ১০৯ দশমিক ৩৩ ডলারে উঠেছে, যা কয়েক মাস আগের তুলনায় ৬২ শতাংশ বেশি। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৬৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতি ব্যারেল ১১২ দশমিক ৬৭ ডলার। প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম আগের তুলনায় ৮৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতি এক হাজার ঘনফুট ৪ দশমিক ৭৭ ডলার।
গ্যাসের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি সার কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন কমাতে বাধ্য করছে বলে জানিয়েছেন বহুজাতিক জায়ান্ট য়ারা ইন্টারন্যাশনালের সিইও যিভেন তোর হলসিথার। য়ারা ইন্টারন্যাশনাল ইউরোপে অ্যামোনিয়া ও ইউরিয়া উৎপাদন কমিয়ে সক্ষমতার ৪৫ শতাংশে আনবে বলে তিনি জানান।
অ্যামোনিয়া ও ইউরিয়ার মতো আবশ্যকীয় দুটি কৃষি উপকরণের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ভীষণভাবে ব্যাহত হবে জানিয়ে যিভেন হলসিথার বলেন, পৃথিবী ধীরে ধীরে খাদ্য সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য সংকট হবে কিনা এটা এখন প্রশ্ন নয়, বরং এ সংকট কত বড় ও ব্যাপক হবে সেটাই ভাবার বিষয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর তিন সপ্তাহের মাথায় তরতর করে বেড়ে চলেছে প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর দাম। সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে গমের বাজারে। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশ মিলিয়ে বিশ্ববাজারে বিক্রি হওয়া গমের ৩০ শতাংশ জুগিয়ে থাকে। যুদ্ধের কারণে গমের মূল্য চলতি সপ্তাহের শুরুতে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ স্তরে ওঠে। প্রতি টন গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০৬ ডলারে, যা কয়েক মাস আগেও ছিল ৬৩৮ ডলার।
সয়াবিন, ভেজিটেবল অয়েল, কর্নের দামেও চলছে ঊর্ধ্বগতি। যথাসময়ে সার না পেলে এসব পণ্যের উৎপাদন কমবে সারাবিশ্বে, যা বাজারকে করবে আরও অস্থির। বাজারে সংকটের কথা মাথায় রেখে এরইমধ্যে কিছু দেশ শস্য রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ শুরু করেছে। এতে করে যাদের পাতে খাবার পৌঁছানো সবচেয়ে জরুরি, তারাই সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়বে।
আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিশরের সরকার গম, মশুর ডালসহ কয়েকটি শস্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। পাম অয়েল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পণ্যটির সবচেয়ে উৎপাদনকারী ইন্দোনেশিয়া, যার প্রভাব পড়বে রান্না থেকে শুরু করে কসমেটিকস, চকোলেটসহ বহু পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে।
খাদ্য সংকটের কথা মাথায় রেখে শুক্রবার জরুরি বৈঠক করেছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট গ্রুপ অব সেভেন (জি৭)। এক যৌথ বিবৃতিতে জি৭ দেশগুলোর কৃষিমন্ত্রীরা বলেছেন, খাদ্য সংকট ঠেকাতে ও মোকাবেলা করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্য যদি আরও বাড়ে তাহলে বৈশ্বিক স্তরে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
খাদ্য নিরাপত্তা যে কেবল দরিদ্র দেশগুলোতেই বিঘ্নিত হবে, এমন নয়। পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলোতেও অনেক নাগরিক সংকটে পড়বে। এমনিতে জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পাশ্চাত্যে ভোক্তাদের পকেটে চাপ পড়েছে। খাদ্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।
শস্যবাজারে অস্থিরতার পুরো দায় রাশিয়াকে দেওয়া যায় না। সরবরাহ ব্যবস্থায় নানারকম বিঘ্ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যাশিত উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম এক দশকে রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে। কোভিডের কারণে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হওয়ায় ক্রয়ক্ষমতাতেও টান পড়েছে। এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বের শস্যবিক্রেতা হিসেবে পরিচিত দুই দেশের যুদ্ধ।
ইউক্রেনে গম বীজ বপনের মৌসুম শুরু হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে এবার নিশ্চিতভাবেই আবাদ ব্যাহত হবে। বিপুল সংখ্যক মানুষ ইউক্রেন ছাড়ছে। যারা থেকে যাচ্ছে তাদের বড় অংশ অস্ত্র হাতে নিয়েছে। এ অবস্থায় চাষাবাদের জন্য ইউক্রেনে আদৌ মানুষ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। ক্ষেত্রে নামার মানুষ পেলেও তারা কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপকরণ পাবে কিনা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কারণ ইউক্রেনে এসব পণ্য আসে কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো হয়ে। যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণ সাগরে বাণিজ্যিক নৌ চলাচল প্রায় বন্ধ বলা যায়। গমের পাশাপাশি সানফ্লাওয়ার অয়েলের নেতৃস্থানীয় সরবরাহকারক ইউক্রেন। বিশ্ববাজারে বিক্রিত এ ভোজ্যতেলের অর্ধেক ইউক্রেন একাই রপ্তানি করে।
র্যাবো ব্যাংকের কমোডিটি মার্কেট অ্যানালিস্ট কার্লোস মেরা বলেন, বছরের বাকি সময় অথবা আগামী বছর, এমনকি অদূর ভবিষ্যতেও ইউক্রেন কোনো শস্য রপ্তানি করতে পারবে কিনা সেব্যাপারে ঘোর আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ইউক্রেনের মতো রাশিয়া থেকেও পণ্য সরবরাহ বন্ধ থাকবে বলা যায়। এমনিতে কেউ যুদ্ধরত দেশে ব্যবসার জন্য যেতে চায় না। উপরন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে কেউ রাশিয়া থেকে পণ্য কিনে আইনি জটিলতায় পড়তে চাইবে না।
খাদ্য চাহিদা মেটাতে আমদানির উপর নির্ভরশীল মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেন ব্রেড বাস্কেটের ভূমিকা রাখে বলে জানিয়েছে এগ্রিকালচারাল মার্কেট ইনফরমেশন সিস্টেম (এএমআইএস)। এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, এই দুটি দেশ থেকে সরবরাহে বিচ্যুতি ঘটলে খাদ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে এবং কোটি কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হারিয়ে যাবে।
উল্লেখযোগ্য খাদ্যশস্য ছাড়াও বিপুল পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি করে থাকে রাশিয়া। বিভিন্ন ধরণের সারের নেতৃস্থানীয় সরবরাহকারক রাশিয়া ও তার মিত্র দেশ বেলারুশ। দুটি দেশই রয়েছে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তালিকায়। আবার রাশিয়া ও বেলারুশ ছাড়া অন্যান্য দেশগুলো নাইট্রোজেন-ভিত্তিক সার উৎপাদন বাড়াতে পারবে না গ্যাস সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে।
বাজারে এরইমধ্যে সারের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। মার্কেট ইন্টেলিজেন্স ফার্ম সিআরইউ গ্রুপের ক্রিস লসন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ডলার দামে, যা এক বছর আগের তুলনায় চার গুণ। প্রত্যাশিক ফলন পেতে হলে কৃষকদেরকে এখনই এই দামে সার কিনতে হবে, কারণ দাম অবিরাম বাড়ছে।
যুদ্ধ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন আমেরিকান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জোহানা ম্যান্ডেলসন ফরম্যান। তিনি বলেন, গম, যব, সয় শস্যের বিরাট ক্ষেতগুলো সার ছাড়া আবাদ করা সম্ভব নয়। যুদ্ধ হচ্ছে বহুদূরে কিন্তু মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিলের কৃষকরা সার নিয়ে ভীষণ উদ্বেগে পড়েছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলেছে, চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ২০১৯ সালে এমন ঝুঁকিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৭০ লাখ। আসন্ন খাদ্য সংকটের আঁচ উন্নত দেশগুলোতেও লাগবে বলে মন্তব্য করেন প্রফেসর জোহানা ফরম্যান।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.