আপনি পড়ছেন

ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে (এনএসই) চিত্রা রামকৃষ্ণ নিজেই প্রতিষ্ঠানের সমার্থক ছিলেন। এনএসই’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তিনি। এনএসইকে বিশ্বের বৃহত্তম ডিরাইভেটিভ এক্সচেঞ্জে রূপান্তরের অন্যতম কারিগর তিনি। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম নারী প্রধানও তিনি। ২০১৬ সালে এনএসই প্রধানের পদ ছাড়ার সময় সবাই ‘ট্রেডিংয়ের রাণী’ চিত্রার ‘অসামান্য অবদানের’ প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।

nse and chitra ramkrishnaট্রেডিংয়ের রাণী আর রহস্যের রাজা

চিত্রার নিজের ও তার বিলিয়ন ডলার এক্সচেঞ্জের সুনাম ধাক্কা খেয়েছে গত মাসে। চিত্রার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর কর ফাঁকি, বাজার সংক্রান্ত গোপনীয় তথ্য ফাঁসসহ বেশকিছু অভিযোগ এনেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই তথ্য ফাঁসের অভিযোগটি মজার। কর্মকর্তারা বলছেন এবং চিত্রা নিজেও স্বীকার করেছেন যে, তিনি হিমালয় অঞ্চলে বসবাসকারী জনৈক নামহীন গুরুকে বছরের পর বছর শেয়ার বাজার সংক্রান্ত নানা তথ্য দিয়েছেন। ওই গুরুর পরামর্শ অনুযায়ী বাজার ও লেনদেনের নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করতেন বলে চিত্রা জানান। ট্রেডিংয়ের রাণী চিত্রার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্যের রাজা অর্থাৎ নামহীন, ঠিকানাহীন গুরুর পরিচয় উদ্ধার করতে গিয়ে পেরেশান ভারতের দুঁদে গোয়েন্দারা।

চিত্রা দাবি করছেন, অজ্ঞাত, অদেখা গুরুর সঙ্গে তিনি কেবল বাজার-সংক্রান্ত সাধারণ তথ্য শেয়ার করতেন। কিভাবে তথ্য শেয়ার করতেন তিনি? -- ইমেইলে। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদের তিনটি সংস্করণের নাম একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে বানানো একটি ইমেইলে বিভিন্ন তথ্য দিতেন চিত্রা। তথ্যগুলো জানার পর কি করণীয় সেটা লিখে ইমেইলের জবাব দিতেন ওই গুরু, যাকে চিত্রা কখনো ‘আপনি’, কখনো ‘স্বামীজি’ আবার কখনো ‘মহামান্য’ সম্বোধন করতেন। এ যেন আধ্যাত্মবাদ আর আধুনিক প্রযুক্তির এক অদ্ভুতুড়ে, অবিশ্বাস্য গল্প। ভারতের সবচেয়ে বড় শেয়ার বাজারটিতে নিরাপত্তাহীনতা ও অসাধু চর্চার জ্বলন্ত উদাহরণ এই ঘটনা।

৫৯ বছর বয়সী চিত্রার হাতে হাতকড়া উঠেছে। তার গুরুর সন্ধানে নানা জায়গা চষে বেড়াচ্ছেন গোয়েন্দারা। অনেকগুলো তদন্ত শুরু হয়েছে বিষয়টিকে ঘিরে। তদন্তে কি বেরিয়ে আসবে বলা যায় না। তবে এটা নিশ্চিত যে ভারতের শেয়ার বাজারের সম্মান আর অহংকারের ভিত টলে গেছে। ভারতের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগও হোঁচট খাবে অবধারিতভাবে। নয়াদিল্লিতে এ সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে বিচারপতি সঞ্জীব আগরওয়াল বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে। এমন কেলেংকারি ঘটলে ভারতে বিনিয়োগ করতে কে আসবে?’

চিত্রা ছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন তার সাবেক সহকর্মী আনন্দ সুব্রহ্মনিয়াম। দুজনের বিরুদ্ধেই অপরাধমুলক অসদাচারের অভিযোগ উঠেছে। তাদের বাসায় একাধিকবার তল্লাশি চালিয়েছেন আয়কর কর্মকর্তারা। চিত্রার উত্তরসূরি ও এনএসইর বর্তমান প্রধান নির্বাহী বিক্রম লিমাই ঘোষণা দিয়েছেন, ২৫ মার্চ বর্তমান নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবার পর এ পদে ফিরে আসতে আগ্রহী নন তিনি।

চিত্রা ও আনন্দ দুজনই কোনোরকম অপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। চিত্রা বলেছেন, গুরু ও তার মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটেনি। খেলার মাঠে কোচ ও মেন্টর যেমন কথাবার্তা বলেন, তেমন নির্দোষ কথোপকথন ছাড়া কিছুই হয়নি।

চিত্রা-আনন্দ উপাখ্যান প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (সেবি) একটি আদেশ প্রকাশের পর। ১৯০ পৃষ্ঠার আদেশে বলা হয়, ট্রেডিংয়ের রাণী হিসেবে খ্যাত চিত্রা রামকৃষ্ণ বছরের পর বছর হিমালয় অঞ্চলের যোগী হিসেবে বর্ণিত জনৈক আউটসাইডারকে শেয়ার বাজার সংক্রান্ত স্পর্শকাতর তথ্য সরবরাহ করেছেন।

সেবির ওই প্রতিবেদনের জন্য নেয়া এক সাক্ষাৎকারে চিত্রা বলেছেন, এনএসইর সিইও থাকাকালে তিনি পথচলার বিভিন্ন নির্দেশনা পেয়েছেন হিমালয়ের যোগীর কাছ থেকে। ২০১৩-২০১৬ সময়কালে চিত্রা এনএসইর সিইও ছিলেন। ওই যোগীর সঙ্গে তার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। কেবলমাত্র ইমেইলে তাদের যোগাযোগ হতো।

যোগী যে ইমেইল আইডি থেকে চিত্রার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন সেটা হলো ঋগআজুরসম অ্যাট আউটলুক ডট কম। বেদের সংস্করণ ঋগ, আজুর ও সম-- এ তিনটি শব্দ জুড়ে দিয়ে আইডিটি বানানো হয়েছে। সেবি বলেছে, কথিত ওই যোগী চিত্রাকে পুতুল বানিয়ে ফেলেছিলেন। এনএসইর তহবিল কোথায় কিভাবে বরাদ্দ হবে, কার পদোন্নতি হবে বা বেতন বাড়বে সবকিছু ওই যোগীর কথামতো করতেন চিত্রা। ২০১৩ সালে ওই যোগীর নির্দেশে তিনি আনন্দ সুব্রহ্মনিয়ামকে নিয়োগ দেন। পুঁজিবাজারে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও আনন্দকে চড়া বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে পদোন্নতি দিয়ে চিফ অপারেটিং অফিসার নিয়োগ করা হয়। একবছরে তিনবার আনন্দের বেতন বাড়ানো হয়। এনএসই’র সবকিছুতে সুব্রহ্মনিয়াম ব্যাপক প্রভাব খাটাতেন। ভারতীয় একটি গণমাধ্যম সুব্রহ্মনিয়ামকে ‘একালের রাসপুতিনের মতো চরিত্র’ বলে অভিহিত করেছে।

রহস্যময় যোগীর পরিচয় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে অনুসন্ধানী দলগুলো। এনএসইর দরজার আড়ালে আসলে কি ঘটেছিল, তা নিয়েও একেক পক্ষের একেক মত। কেলেংকারি তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ুংকে নিয়োগ দিয়েছিল এনএসই। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ুং মনে করছে, সুব্রহ্মনিয়াম নিজেই যোগী সেজে চিত্রাকে বিভ্রান্ত করেছেন। তবে সেবি তা মনে করছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির ধারণা, যোগী আসলে অন্য কেউ।

এনএসইর চিত্রা কেলেংকারি যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত। মুম্বাইয়ের স্টক ব্রোকার ও ব্যাংকারদের আঁতাত ভাঙতে ও দুর্নীতি দূর করতে এনএসই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮৭৫ সালে পথচলা শুরু করে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ। ১৯৯২ সালে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন ইকুইটিতে ব্যাংকগুলোর ২০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ঢুকিয়ে বাজার টালমাটাল করেছিলেন হর্ষদ মেহতা। এ সংক্রান্ত মামলার বিচার শেষের আগেই মেহতার মৃত্যু হয়। হর্ষদ মেহতা কেলেংকারি প্রকাশের পর মুখ থুবড়ে পড়ে ভারতের শেয়ার বাজার। এরপর নড়েচড়ে বসেন নীতি নির্ধারকরা।

একটি আধুনিক, স্বচ্ছ, ডিজিটাইজড বাজার গড়ার চিন্তা থেকেই এনএসইর জন্ম। নব্বই দশকের প্রথমদিকে আইডিবিআইতে কাজ করতেন চিত্রা। আইডিবিআইতে থাকাকালে তিনি ভারতের পুঁজিবাজার আধুনিকায়নের একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে অংশ নেন। মূলতঃ এই অভিজ্ঞতার কারণেই চিত্রা ডাক পান এনএসইর পথনকশা প্রণয়নের কাজে। তাকে এবং তার মতো একদল তরুণ কর্মীকে নিয়ে এনএসইর পথচলা শুরু। উম্মুক্ত ফ্লোরে হইচই চেঁচামেচির পরিবর্তে ইলেকট্রনিক সিস্টেমে লেনদেন প্রবর্তন করে এনএসই। স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এনএসই ফ্লোরের সুপরিসর স্ক্রিনে সারা ভারতের বাজারগুলোর দর ওঠানামার চিত্র দেখানো শুরু করে। এই আপাতঃ স্বচ্ছতা ও আধুনিকতার টানে ক্রমেই বিনিয়োগকারীরা এনএসইর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন।

এনএসইর শনৈ শনৈ উন্নতি হতে থাকে, সেই সঙ্গে চিত্রারও। ২০১৩ সালে তিনি এনএসইর প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন। সে সময় বিশ্বে তিনিসহ মাত্র তিনজন নারী শেয়ার বাজারের শীর্ষ নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৫ সালে ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চিত্রা মহাত্মা গান্ধীকে তার আদর্শ বলে দাবি করেন। এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফিউচারস বা ইটিএফের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট করা তার স্বপ্ন বলে চিত্রা জানান। এতেই শেষ নয়, স্বয়ং গান্ধী বেঁচে থাকলে এসব ইটিএফ কিনতেন বলেও তিনি গর্বভরে উচ্চারণ করেন।

পচনের শুরু হয়েছিল প্রথম দিন থেকেই। সিইও পদে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই আনন্দ সুব্রহ্মনিয়ামকে নিয়োগ দেন চিত্রা। অল্পদিনেই সুব্রহ্মনিয়ামের বেতন বেড়ে পাঁচ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এনএসইর সবাই তার চোটপাটে অস্থির থাকতেন। চিত্রা ও সুব্রহ্মনিয়ামের জন্য পৃথক লিফটের ব্যবস্থা করা হয়। সুব্রহ্মনিয়াম ট্রেডিং ফ্লোরে নামলে সঙ্গে থাকত একদল লোক, যারা রেস্টরুমে তার জন্য পৃথক সোপ ডিসপেন্সার ও হ্যান্ড টাওয়েল সাজিয়ে দিত। শেষ পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তারা চিত্রা-সুব্রহ্মনিয়াম আখ্যান থেকে কি উপসংহারে আসবেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এরইমধ্যে বেশকিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী এনএসই থেকে পুঁজি তুলে নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সিটিগ্রুপ, গোল্ডম্যান স্যাকস, নরওয়েস্ট ভেঞ্চার পার্টনারস। আরও কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী হাত ধোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.