আপনি পড়ছেন

মঙ্গলবার ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের বৈঠক চলাকালে মস্কোয় রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু কিয়েভ ও চেরনিয়েভের দিকে আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে কিয়েভের আশপাশ থেকে রুশ সৈন্যরা সরে যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়। অনেকে বিষয়টিকে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বেকায়দা অবস্থানের লক্ষণ হিসেবে দেখছেন।

russian raid in ukraineইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান

তাদের ধারণা, যুদ্ধে হেরেছে বলেই রাশিয়া এ পদক্ষেপ নিয়েছে। বিষয়টি তা নয়। আরও জোরদার লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসেবেই কিয়েভ ও সংলগ্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে আনছে রাশিয়া। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনবাস অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন অথবা ওই অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে নেওয়াই মস্কোর কর্মকর্তাদের লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের আকস্মিক এ ইউটার্ন বুঝতে হলে সমরকৌশল সংক্রান্ত মৌলিক ধারণাগুলো মাথায় থাকা জরুরি। ম্যানুভার ওয়ারফেয়ার বলে একটি বিষয় আছে। যুদ্ধের চাল হিসেবে চাতুর্যপূর্ণ সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত ও ঘায়েল করাই ম্যানুভার ওয়ারফেয়ারের মূলকথা।

মনে রাখা জরুরি যে, গুরুতর জনবল ঘাটতি নিয়েই রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান শুরু করেছে। রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর লাখ দেড়েক সৈন্য, সঙ্গে চেচেন যোদ্ধাদের একটি দল এবং দোনেতস্ক ও লুহানস্কের কিছু মিলিশিয়া- সর্বসাকুল্যে দুই লাখ জনবল নিয়ে পুতিন এ অভিযান শুরু করেন। এই দুই লাখ আক্রমণকারীর বিপরীতে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় ছিল নিয়মিত সৈন্য, ন্যাশনাল গার্ড এবং আযভ ও অন্যান্য মিলিশিয়া মিলিয়ে প্রায় ছয় লাখ জনবল। এমন অসম শক্তি নিয়ে প্রথাগত সম্মুখ ও পরস্পরক্ষয়ী (অ্যাট্রিশনাল) যুদ্ধে নামার কোনো চিন্তা রুশ জেনারেলদের ছিল না। জিততে হলে ম্যানুভার ওয়ারফেয়ারে যেতে হবে, এটা তারা আগেই ভেবেছেন।

ম্যানুভার যুদ্ধ যতটা শক্তিনির্ভর, তার চেয়ে ঢের বেশি মনস্তাত্বিক। আবার, এমন যুদ্ধে পূর্বনির্ধারিত কৌশলের (ট্যাকটিক্যাল) চেয়ে প্রায়শ পরিচালনকালীন (অপারেশনাল) সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে হয়। রীতিমতো আপেক্ষিক যুদ্ধ বলা যায়। প্রতিপক্ষের শক্তি ও অবস্থান মাথায় রেখে নিজের শক্তি ও জনবল মোতায়েন করতে হয়। চলতি সপ্তাহের শুরুতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে অভিযানের প্রথম পর্বের কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এই ‘প্রথম পর্বের কাজগুলো’ কি কি তা তিনি বলেননি। তবে এ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন, বিশেষত দুই পক্ষের সংঘর্ষের জায়গাগুলো ও রুশ বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুগুলো দেখলে।

প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক কম জনবল নিয়ে যুদ্ধে নামা রাশিয়ার জন্য সবার আগে জরুরি ছিল যুদ্ধক্ষেত্রকে নিজের সুবিধামতো আকার দেওয়া। যুদ্ধক্ষেত্রকে সুবিধামতো সাজাতে দরকার ছিল ইউক্রেনের সেনা মোতায়েনের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে অধিকতর শক্তিধর বাহিনীকে ইউক্রেন কিভাবে কোথায় মোতায়েন করবে, তার নিয়ন্ত্রণ রাশিয়া নিয়েছিল খুব চাতুর্যপূর্ণ আক্রমণ ও সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে, যাতে কম জনবল নিয়ে প্রতিপক্ষকে অনেক বেশি ব্যতিব্যস্ত রাখা যায়।

দোনবাস কয়লা খনি অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে বিতাড়নের লক্ষ্য ঘোষণা করেছে রাশিয়া। এ হিসেবে উত্তরে খারকিভ, দক্ষিণে খারসন আর মধ্যাঞ্চলে দনিপ্রোপেত্রোভস্ক- এই তিন ফ্রন্টের মধ্যে ম্যানুভারের সুবিধার্থে কৌশলগত বিবেচনায় রাশিয়ার জন্য খুব জরুরি হলো ক্রাইমিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে একটি স্থল-সেতু নিশ্চিত করা। উপকূলীয় শহর মারিউপল দখলে এলে কাজটি সম্পন্ন হবে।

মারিউপল দখলের অভিযান গোড়া থেকেই জটিল। শিল্প-সমৃদ্ধ শহরটিতে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার সৈন্য ছিল ইউক্রেনের (যার মধ্যে প্রায় চারশ এখনও শহরের বিভিন্নস্থানে লুকিয়ে আছে)। মারিউপলে রাশিয়ার অভিযান ব্যাহত করতে ইউক্রেন যাতে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশের সুযোগ না পায় সেজন্য ইউক্রেনীয় বাহিনীকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখা দরকার ছিল। এজন্য ফেইন্ট, ফিক্সিং অপারেশন ও ডিপ অ্যাটাকের মতো বেশকিছু রণকৌশলগত ধারণা কাজে লাগিয়েছে রাশিয়া।

ফেইন্ট বা কৃত্রিম আক্রমণের ধারণাটি হলো নিজের লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরের কোনো জায়গায় আক্রমণের প্রস্তুতি সাজিয়ে অথবা আক্রমণ করে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করা, যাতে আসল লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ ঠেকাতে যথেষ্ট সৈন্য ও রসদ নিয়োগ করতে না পারে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনী এই কাজটি চতুরভাবে সম্পন্ন করেছে। এর আগে নব্বই দশকে ফেইন্ট কৌশলেই ইরাকি বাহিনীকে পরাজিত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ডেজার্ট স্টর্ম নামের ওই অভিযানের শুরুতেই কুয়েত উপকূলে সপ্তম মেরিন কোরের বিপূল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে যুক্তরাষ্ট্র। বাধ্য হয়ে সাদ্দাম হোসেন সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করেন আক্রমণ ঠেকাতে, এমন আক্রমণ যা শেষপর্যন্ত কখনো ঘটেনি। 

একই সময়ে কুয়েতের দক্ষিণ সীমান্তের কাছে বেশকিছু ডিসেপশন (বিভ্রান্তকরণ) সেল নিযুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। এসব সেলের কাজ ছিল কম্পিউটারের মাধ্যমে একটি ইলেকট্রনিক সিস্টেম গঠন করা, যা ভিএইচএফ-ইউএইচএফ বেতার যোগাযোগের কৃত্রিম সিমুলেশন তৈরি করবে। ইরাকের সামরিক গোয়েন্দারা এসব বেতার যোগাযোগ শনাক্ত করে দক্ষিণ সীমান্তে মার্কিন বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা চলছে বলে ভাবতে থাকেন। ইরাকিদের এ দুটি দিকে ব্যস্ত রেখে তুলনামূলক কম সময়ে কম জনবল নিয়ে ওয়াদি আল বাতিনে রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীকে পরাস্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ক্যাভালরি ডিভিশন।

মার্কিনিরা যেভাবে কুয়েতের পশ্চিম উপকূলে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল, ঠিক সেভাবে এবার ইউক্রেনের ওডেসা উপকূলে বিপুল সংখ্যক মেরিন সেনা মোতায়েন করেছিল রুশ বাহিনী। জবাবে ইউক্রেনও সেখানে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। রুশ বাহিনীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ফেইন্ট ছিল কিয়েভ অভিমুখে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যানের বিরাট বহর পরিচালিত করা। প্রায় ৪০ মাইল দীর্ঘ গাড়িবহর দেখে স্বভাবতই ইউক্রেনি বাহিনী রাজধানীর সুরক্ষায় ব্যাপক সৈন্য ও সমরাস্ত্র মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। আদতে কিয়েভের ভেতরে ও আশপাশে কিছু কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে গোলাবারুদ ছোঁড়া ছাড়া দীর্ঘ এই বহর কিছুই করেনি। কিন্তু তাদের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিমুহূর্তে তটস্থ থাকতে হয় ইউক্রেনিয়ান বাহিনীর এক বিরাট অংশকে। এ সুযোগে রুশরা মারিউপল, লুহানস্ক, খারসন ও খারকিভে নিজেদের আভিযানিক লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে যায়।

ইউক্রেনীয় বাহিনী দোনবাস অঞ্চলের মুখোমুখি অবস্থানে প্রায় এক লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছিল। রাশিয়ার ফিক্সিং আক্রমণগুলো স্থানীয় বাহিনীকে জাপরোঝঝিয়া, দনিপ্রোপেত্রোভস্ক, সুমি, চেরনিয়েভসহ কয়েকটি জায়গায় অধিকতর সৈন্য ব্যস্ত রাখতে বাধ্য করে। এতে করে মারিউপলের সুরক্ষায় অতিরিক্ত সৈন্য আনা তাদের পক্ষে যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি ক্রাইমিয়া থেকে খারসনে রুশ বাহিনীর চালানো আক্রমণ ঠেকানোও সম্ভব হয়নি।

রাশিয়ার অভিযানের প্রথম পর্বের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল কৌশলগত গভীর আক্রমণ (স্ট্র্যাটেজিক ডিপ অ্যাটাক)। ইউক্রেনের রসদ, অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিমান যুদ্ধের সামর্থ্য, দূরপাল্লায় গোলা ছোঁড়ার সক্ষমতা এবং দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল ভেঙে দিয়েছে রাশিয়া। অস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানি- কোনোটারই মজুত নেই ইউক্রেনের কাছে। বিমান ওড়ানো বা মিসাইল ছোঁড়ার বিষয়টিও ইউক্রেনের জন্য অতীত বলা যায়। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলতেও কিছু অবশিষ্ট নেই। দোনবাস অঞ্চলে গত আট বছর ধরে যেসব প্রতিরক্ষা স্থাপনা ও দুর্গ তৈরি করেছে ইউক্রেন, সেগুলো ধ্বংসের কাজও প্রায় শেষ।

রাশিয়া এখন কিয়েভ ও চেরনিয়েভ অঞ্চল থেকে সরিয়ে আনা সৈন্য, গোলাবারুদ দোনবাস অঞ্চলের কাছে মোতায়েন করবে। উত্তরে খারকিভ, লুহানস্ক আর দক্ষিণে খারসন থেকে যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে ইউক্রেনিয়ার বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা হবে। এই ফাঁকে রুশ বাহিনীর মূল অংশ, কিয়েভ চেরনিয়েভ থেকে সরিয়ে আনা সৈন্যরা, মারিউপলে ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হওয়া সৈন্যরা এবং ক্রাইমিয়া ও ওডেসায় অবতরণকারী রুশ মেরিনরা দোনবাসের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত লাখ খানেক ইউক্রেন সৈন্যকে জেঁকে ধরবে। এটাকেই সম্ভবত ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ অভিযানের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্ব বলে অভিহিত করবেন ভ্লাদিমির পুতিন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.