বিজেপি-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে হজের কাজ দিয়েছে সৌদি আরব!

পশ্চিমা দেশগুলো থেকে হজের আবেদন সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণে সৌদি সরকার যে কোম্পানিকে নিয়োগ দিয়েছে তার অন্তত একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ভারতের বিজেপি সরকারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদ পোর্টাল মিডল ইস্ট আই এ তথ্য জানিয়েছে।

হজ্বের সময় অত্যাসন্ন জেনেও নতুন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে সৌদি আরব

গত সপ্তাহে সৌদি সরকারের এক ঘোষণায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে হজ গমনেচ্ছুদের এখন থেকে সৌদি সরকারের পোর্টাল মোতাওয়িফের মাধ্যমে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণা ঠেকাতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সৌদি সরকারের দাবি।

নতুন প্রক্রিয়ায় আবেদনকারীরা স্বয়ংক্রিয় লটারির মাধ্যমে হজের জন্য নির্বাচিত হবে জানিয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছে, নির্বাচিতরা সরকারি পোর্টালের মাধ্যমেই সৌদি আরবে পরিবহন টিকেট, হোটেল রুম ইত্যাদি বুকিং ও মূল্য পরিশোধ করতে পারবে।

চলতি বছরের হজের সময় অত্যাসন্ন জেনেও তড়িঘড়ি কেনো এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলো সে বিষয়ে সৌদি সরকার বিস্তারিত কিছু বলেনি। তবে মিডল ইস্ট আইয়ের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোতাওয়িফ পোর্টালের মাধ্যমে আসা পশ্চিমা নাগরিকদের আবেদন প্রক্রিয়াকরণের একচ্ছত্র ঠিকাদারি পাওয়া দুবাই-ভিত্তিক কোম্পানি ট্রাভইজি’র একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপির ঘনিষ্ট সংযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, ট্রাভইজির অন্যতম বিনিয়োগকারী প্রশান্ত প্রকাশ গত বছর ভারতের কর্নাটক রাজ্যের বিজেপি-দলীয় মুখ্যমন্ত্রী বাসভরাজ বোম্মাইয়ের পলিসি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি অ্যাডভাইজর নিযুক্ত হন। ২০২০ সাল থেকে তিনি ভারতের ন্যাশনাল স্টার্ট আপ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের সদস্য পদে রয়েছেন। সে বছরের নভেম্বরে তিনি কোভিড প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেন। গত ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকের অতিথি ছিলেন প্রশান্ত প্রকাশ।

প্রশান্ত প্রকাশ হচ্ছেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান এক্সেল ইন্ডিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট। এক্সেল ইন্ডিয়ার সঙ্গে আরও দুটি কোম্পানির বিনিয়োগ নিয়ে মোট ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগে প্রশান্ত প্রকাশ ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন কোম্পানি ট্যাভইজি। ২০১৮ সালে ট্রাভইজিতে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে এক্সেল ইন্ডিয়াসহ ছয় বিনিয়োগকারী। একই বছর ট্রাভইজির সহযোগী কোম্পানি উমরাহমি গঠন করা হয়।

ব্যবসা বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের তথ্য মতে, সারাবিশ্বের ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছে উমরাহ বিষয়ক প্যাকেজ বিক্রির অনুমোদনপ্রাপ্ত তিন প্রতিষ্ঠানের একটি হলো উমরাহমি। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগপ্রাপ্ত ৫০টি স্টার্ট আপ কোম্পানির মধ্যে ২০২০ সালে উমরাহমি ছিল পঞ্চম অবস্থানে।

হজ ও উমরাহ ব্যবসায় এমন দাপটের বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে ট্রাভইজির সিইও গীত ভাল্লা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব দেননি। প্রশান্ত প্রকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও তার কোনো মন্তব্য এখনো মিডল ইস্ট আইয়ের কাছে পৌঁছেনি।

হজের কাজে এমন মুনাফাজনক চুক্তি বিজেপি নেতাদের পকেট ভারি করবে জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভারতের মুসলিম ও মানবাধিকার সংগঠকরা।

ভারতের মুসলিম সংগঠন নবিয়া খান বিজেপির সঙ্গে বিনিয়োগ সম্পর্কে যুক্ত একটি কোম্পানিকে হজ সংক্রান্ত ঠিকাদারির কাজ দেওয়ার খবরকে ‘বিপজ্জনক’ অভিহিত করে বলেন, হিজাব ও আজানে বিধিনিষেধ আরোপসহ বেশকিছু মুসলিম বিদ্বেষী নীতির কেন্দ্রে রয়েছে কর্নাটকের বিজেপি সরকার। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসভরাজ বোম্মাই নিজেই আন্তঃধর্মীয় বিয়েতে হিন্দু কট্টরপন্থীদের হস্তক্ষেপকে উৎসাহিত করেছেন।

ট্রাভইজি ও উমরাহমির মতো প্রতিষ্ঠানকে হজ্বের কাজ দেওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর মুসলমানদের ব্যক্তিগত তথ্য ভুল হাতে চলে যেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে মুসলিম দেশগুলো এতো স্পর্শকাতর তথ্য ও ব্যবসা এমন লোকজনকে দিচ্ছে যাদের অর্থ আখেরে ভারতে মুসলমানদের উপর নিপীড়নের হাতকে শক্তিশালী করবে।

সৌদি আরবের হজ ও উমরাহ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দেশটির নিউইয়র্কস্থ কনস্যুলেটের সঙ্গে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করে কোনো সাড়া মেলেনি।

নিউইয়র্ক ভিত্তিক দ্য পোলিস প্রজেক্টের নির্বাহী পরিচালক সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা কিভাবে দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার একটি উদাহরণ হচ্ছে প্রযুক্তি শিল্প। এক্সেল ইন্ডিয়া দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের স্টার্ট আপ খাতেও বিনিয়োগ করছে। ২০০২-২০১৬ সময়কালে ইসরায়েলের স্টার্ট আপে কোম্পানিটির বিনিয়োগ ৩৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায় বলে জানা গেছে।

তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের একটি দিক হলো নজরদারি পুঁজিবাদ বা সার্ভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম। হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণা এবং মুসলমানদের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের তীব্র ঘৃণা এখন বৈশ্বিক উপসর্গ হয়ে উঠেছে। ঘৃণা এক বিরাট ব্যবসা। হিন্দুদ্ববাদীরা ঘৃণা ও সহিংসতা থেকেও অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে।

এদিকে সৌদি সরকার বাধ্যবাধকতা আরোপের পর থেকে এরইমধ্যে হজে গমনেচ্ছুদের অনেকে মোতাওয়িফ পোর্টালে নিবন্ধনের পরপর স্প্যাম অত্যাচারের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এতে করে হজ্ব গমনেচ্ছুদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও তাদের তথ্যের নিরাপত্তার প্রশ্নটি আবার সামনে এসেছে। মোতাওয়িফ ওয়েবসাইটে ডাটা প্রটেকশন পলিসি নিয়েও কোনো বক্তব্য নেই।