পাঁচ কক্ষ নিয়ে তার বিশাল এক কম্পাউন্ড। অপরিচিত কারো কাছে দূর থেকে মনে হবে ওটা একটা স্কুল, যেখানে শিশুরা খেলছে। আসলে একটি কোনো স্কুল ঘর নয়। এটি মারিয়াম নাবাতানজির ঘর। শিশুগুলো সব ওই নারীর সন্তান। উগান্ডায় ৩৭ বছর বয়সী এই নারী ৩৮ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তাকে নিয়ে বিশ্ব মিডিয়া খবর প্রচার করে কৌতুহলী মানুষদের কাছে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে। সৌভাগ্যবান ওই নারীর বাড়ি উগান্ডার মুকোনো জেলার কাবিমবিরি গ্রামে।

uganda marium

হইচই ফেলে দেয়া ওই নারীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডেইলি মনিটর, ইয়াহু নিউজ, আফ্রিকান নিউজসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রখ্যাত গণমাধ্যম। প্রতিবেদনে জানানো হয়, সন্তানদের মধ্যে ছেলেই বেশি। তিনি ২৬ জন ছেলে ও ১২ জন মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। সবার বড় সন্তানের বয়স এখন ২৩ বছর। আর সবার ছোটটির বয়স মাত্র ১০ মাস।

ডেইলি মনিটর জানায়, মারিয়াম নাবাতানজি ছয় বার যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর মধ্যে একসঙ্গে তিনটি করে সন্তান জন্ম দিয়েছেন চারবার। এ ছাড়া একসঙ্গে চারটি করে সন্তান জন্ম দিয়েছেন তিনবার। বাকি দুটি সন্তান এককভাবে পৃথিবীর মুখ দেখেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানায়, ওই নারী তার এই ফার্টিলিটি (সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা) এত বেশি যে, তার শরীরে কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কাজ করতো না। যতবার সে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে ততবার তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটেছে।

যেভাবে দিন কাটে মারিয়ামের

মরিয়ামের দিনের শুরু হয় কাপড় ধোয়া দিয়ে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে এতগুলো সন্তানের ময়লা হওয়া কাপড়গুলো ধুতে যান। কাপড়গুলো ধুতে ধুতেই সকালের নাস্তার সময় হয়ে যায় তার। এর মধ্যে গৃহস্থালীর অন্য কাজগুলোও সারেন। নাস্তার সময় সব ছেলেমেয়েদের গোল করে বসান। একবারে কিনে আনা রুটি দিয়ে তাদের হয় না। একাধিকবার দোকানে যেতে হয়।

uganda marium2

তারপর বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর কাজ। আবার দুপুরের খাবারের আয়োজন। এসব কিছুতেই সময় চলে যায় মরিয়মের। একটুও বিশ্রামের ফুসরত নেই তার। তার বড় ছেলে চার্লস মুসিসি (২৩) বলেন, 'আমরা আমাদের বড় হওয়ার ক্ষেত্রে বাবার কোনো আদর পাইনি। সব পেয়েছি মায়ের কাছে। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার ভাইবোন জানে না বাবা কী জিনিস। আমি তাকে সর্বশেষ ১৩ বছর বয়সে দেখেছিলাম। তিনি শুধু রাতে আসেন।'

প্রথম গর্ভবতী হওয়ার গল্প

তিনি ১৯৯৪ সালে প্রথম অন্তঃস্বত্ত্বা হন। যখন তার বয়স ১৩ বছর, তখন তিনি তার প্রথম সন্তান জন্ম দেন। গ্রামের স্বাভাবিক নিয়মের মতই তিনি সন্তান জন্ম দেন। ওই প্রসবের ধাত্রী ছিলেন তার নিজের দাদি। এর মধ্যে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন ৫ শিশু তার পেটে নষ্টও হয়েছে। যখন তার ১৮টি সন্তান হয়েছিল তখন তিনি গর্ভবতী হওয়া বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।

মরিয়াম জানান, তিনি অনেকবার চেষ্টা করেছেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করার। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে তিনি বলেন, 'আমি যখনই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির পরিকল্পনা করেছি, তখনই নানা সমস্যা হয়েছে। এজন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা আমাকে বলেছে, আমি যেন তা গ্রহণ না করি। তারা বলেছে, তুমি সন্তান জন্ম দিতে থাকো, না হয় তুমি মারা যাবে।'

uganda marium3

স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইয়াহু নিউজ জানায়, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার অতিমাত্রায় সন্তান উৎপাদনে সক্ষমতা থাকার কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হত।

কেন এমন হয়

চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, ডিম্বস্ফুটনের সাত দিন ব্যাপী সময়ের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে মিলন হলে একজন স্ত্রীর গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। সাধারণত শেষ মাসিকের ১২ দিন এই সময় আসে। একটি ডিম্বানু ডিম্বাশয় থেকে নির্গত হওয়ার পর ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে। গর্ভধারণের লক্ষ্যে এ সময়ের মধ্যে ডিম্বাণুটিকে শুক্রাণুর সাথে মিলিত হতে হবে। এমন কোন তথ্য নেই যে যেই দিন ডিম্বস্ফুটন হয় শুধু সেই দিন মিলিত হলেই আপনি গর্ভবতী হতে পারবেন। একজন নারীর শরীরে শুক্রাণু ৪-৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এই কারণে ডিম্বস্ফুটনের ৪-৫ দিন মিলন হলেও শুক্রানুটি ডিম্বাণুর জন্যে ডিম্বনালীর ভেতরে অপেক্ষা করে থাকতে পারে।

উগান্ডার জাতীয় রেফারেল হসপিটালের গাইনোলজিস্ট বিভাগের কনসালটেন্ট চার্লস কিগুডু বলেন, 'তার এ সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নয়। কিছু নারীর মাঝে এমন প্রবণতা থাকতে পারে। কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতি মাসে একজন নারীর শরীরে ১২ থেকে ১৫টি কার্যকর ডিম্বানু উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে সাধারণত জরায়ুতে চূড়ান্তভাবে এক থেকে দুটি টিকে গিয়ে তার সন্তানে পরিণত হয়।

তিনি বলেন, 'এটি জেনেটিক ফ্যাক্টর, পরিবেশগত ফ্যাক্টর হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে তার এ ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।' ডা. কিগনডো আরও জানান, বিভিন্ন মিডিয়ায় এই নারীকে উগান্ডার সবচেয়ে বেশি ফার্টাইল নারী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

দু:খে ভরা জীবন

মারিয়াম ছোটবেলায় তার মাকে হারান। তার বাবা অনেকগুলো বিয়ে করেছিলেন। একদিন তার সৎ মা তাকে তার চার ভাইবোনসহ খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। তার ভাইবোনরা ঘটনাস্থলে সবাই মরে গেলেও সে যাত্রায় তিনি সৌভাগ্য ক্রমে বেঁচে যান।

বাবা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমার বাবা অনেকগুলো বিয়ে করেছেন। তার (বাবার) সন্তানের সংখ্যা ৪৫ জন। আমার সৎ মায়েদেরও এক সঙ্গে ৪টি, তিনটি ও দুটি করে সন্তান হয়েছে।'

১২ বছর বয়সী মারিয়মের বিয়ে হয় এক চল্লিশ বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে। বিয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যখন আমার বিয়ে হয় তখন বিয়ে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। মানুষ আমার বাবার কাছে আসা-যাওয়া করত। একদিন আমাদের বাড়িতে মেহমান আসল। চাচী আমাকে একজন পুরুষের (স্বামী) কাছে নিয়ে গেল।'

uganda marium4

এ কিশোরী যখন তার শ্বশুরবাড়িতে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল আরও কঠিন পরিবেশ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীও এর আগে অনেকগুলো বিয়ে করেছেন। তারও অনেক সন্তান। তাদের ছেড়ে তাদের মায়েরা চলে গেছে। সেগুলোকে আমারই দেখভাল করতে হতো। আর কোনো কাজ পছন্দ না হলে আমাকে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হতো।

বিয়ের পরের বছর জমজ শিশুর জন্ম দেন মারিয়ম নাবাতানজি। দুই বছর পর তার কোলজুড়ে আসে একসঙ্গে তিন সন্তান। এর এক বছর সাত মাস পর আরও চার সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এভাবে চলতেই থাকে। 'একবার আমি চেষ্টা করেছি এক ধরণের (ইন্টার আটারিং ডিভাইস) প্রক্রিয়ায় এটা বন্ধ করতে চেয়েছি। কিন্তু সফল হইনি। এজন্য আমি আমি প্রায় একমাস কোমায় ছিলাম। মৃত্যুর কাছাকাছি ছিলাম।' বর্ণনা করেন তিনি। মরিয়ম বলেন, ‘আমি এখন নিয়মিত মোলাগো হসপিটালে চেকআপ করি, তাদের পরামর্শে জীবনযাপন করি’।

ছেলে মেয়েদের নিয়ে ওই নারীর স্বপ্ন

তিনি তার সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হিসেবে দেখতে চান। মরিয়ম জানান, তার এতগুলো সন্তানকে তিনি এক হাতে মানুষ করেছেন। গত কয়েক মাস আগে তার স্বামী তাকে ভুল বুঝে ছেড়ে দিয়েছে। তার সবচেয়ে বড় মেয়ে ইতিমধ্যে নার্সিং ট্রেনিং সম্পন্ন করে চাকরি করছে। সন্তানদের সবার টেবিলে খাবারের সংস্থান তাকেই করতে হয়। প্রায় সময় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীও এসে খাবার দিয়ে যান। সৌভাগ্যবশত তার কিছু ছেলেমেয়েকে সরকার বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে।

মারিয়াম বলেন, 'আমি আমার খাবারের জন্য সংগ্রাম করি। আমার ছেলেমেয়েদের শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার চেষ্টার কোনো কমতি রাখি না।' জীবন সংগ্রামী এ নারী ডেইলি মিররকে বলেন, 'আমি কষ্ট করে আমার ছেলেমেয়েদের মানুষ করছি। তারা স্কুলে যায়। আমার আশা একদিন তারা ডাক্তার, শিক্ষক ও ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমি এটা শুধু প্রত্যাশা করি, কিন্তু এটি বাস্তবে হবে কিনা তা জানি না।'

Discover extraordinary stories from around the world with our exceptional news coverage. From uplifting human interest stories to groundbreaking scientific discoveries, we bring you the best of the best. Stay informed about the latest breakthroughs in technology, medicine, and beyond, and explore the world's most fascinating cultures and communities. Get inspired and informed with our exceptional news coverage.