দক্ষিণ কোরিয়ার অস্ত্র ব্যবসায় বিপ্লব

অস্ত্র ব্যবসায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে দক্ষিণ কোরিয়া। বৈশ্বিক অস্ত্র বাজারে দেশটির রপ্তানির পরিমাণ পাঁচ বছর আগের তুলনায় প্রায় তিনগুণ হয়েছে। অস্ত্র রপ্তানির হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্সের মতো বাঘা বাঘা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া।

অস্ত্র রপ্তানিতে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া

বিগত বছরে দক্ষিণ কোরিয়া ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের অস্ত্র রপ্তানি করেছে। দেশটির এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭-২০২১ সময়কালে দক্ষিণ কোরিয়ার অস্ত্র রপ্তানিতে পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের চেয়ে ১৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে বিশ্বের শীর্ষ ২০ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাজার-অংশ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার। এরপর রয়েছে অস্ট্রেলিয়া (৯৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) ও ফ্রান্স (৫৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি)।

দক্ষিণ কোরিয়ার অস্ত্র ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির মূল কারিগর দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন। ২০১৭ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তেজি ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে কোরীয় অস্ত্রের বাজার। পাঁচ বছরেই বিশ্বের প্রথম সারির অস্ত্র রপ্তানিকারক হিসেবে আবির্ভুত হয় দক্ষিণ কোরিয়া।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আর্মস ট্রান্সফার ডেটাবেজ অনুযায়ী, ২০০০ সালে অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান ছিল ৩১তম। ২০২১ সালে তালিকার ৮ম স্থানে উন্নীত হয়েছে দেশটির। সে বছরই প্রথমবারের মতো অস্ত্র আমদানি ব্যয়ের চেয়ে অস্ত্র রপ্তানিতে বেশি আয় করে দক্ষিণ কোরিয়া।

চলতি বছরে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার মোট অস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলার ছাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা ২০১০-২০২০ দশকে দেশটির বার্ষিক রপ্তানির তিনগুণের বেশি। পরিস্থিতি দেখে বুঝা যাচ্ছে, নিশ্চিতভাবেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বিক্রির পরিমাণ।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি মাল্টিমিলিয়ন ও মাল্টিবিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। এর মধ্যে রয়েছে- অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও মিশরের কাছে কে-নাইন সেলফ প্রপেলড হাউয়িটজার বিক্রির তিনটি চুক্তি; সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মাঝারি পাল্লার মিসাইল বিক্রির চুক্তি ও সৌদি আরবের কাছে মিসাইল-ডিফেন্স সিস্টেম বিক্রির চুক্তি।

কামান আর মিসাইল শুধু নয়, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে জঙ্গি বিমান কেনার চুক্তি করেছে অন্তত আধ ডজন দেশ। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইরাক, কাতার, সেনেগাল ও পেরু দক্ষিণ কোরিয়ার কেএফ-২১ জঙ্গিবিমান কিনতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার অস্ত্র ব্যবসায়ে বাড়তি গতিসঞ্চারের সুযোগ এনেছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সহযোগিতা জোগাতে নিজেদের পুরোনো অস্ত্র ও গোলাবারুদ তড়িঘড়ি কিয়েভের কাছে হস্তান্তর করেছে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ। এবার নিজেদের অস্ত্র মজুত ঝালিয়ে নিতে সিউলের শরণাপন্ন হয়েছে এসব দেশ।

পোল্যান্ড সরকার এরইমধ্যে প্রায় এক হাজার ট্যাঙ্ক, ছয়শোর বেশি কামান ও সাঁজোয়া যান ও ৪৮টি জঙ্গি বিমান কিনতে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে। একইরকম চুক্তির লক্ষ্যে সিউলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে আরও কয়েকটি দেশ।

উত্তর কোরিয়ার মতো বৈরী ও চীনের মতো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার খেয়াল থেকেই অস্ত্র রপ্তানিতে মনোযোগী হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। পাশাপাশি আরেকটা চিন্তাও সাবেক প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন ও অন্যান্য নীতি-নির্ধারকদের মাথায় কাজ করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীতে নিয়মিত সৈন্য কম। স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়েই কোরীয় সেনাবাহিনী। এদিকে দেশের জনসংখ্যা কমছে। প্রজনন হার ক্রমশ কমছে। এ অবস্থায় কনস্ক্রিপশন-নির্ভর সেনাবাহিনী একপর্যায়ে প্রয়োজনীয় জনবলের জোগান পাবে না। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য জনবল ঘাটতি পুষিয়ে নিতে প্রয়োজন সামরিক প্রযুক্তির আধুনিকায়ন। আর, সামরিক প্রযুক্তিকে মুনাফামুখী করলে প্রতিযোগিতার চাপে সেটির আধুনিকায়ন হবেই।