মার্কিনিদের ফাঁকি দিয়ে কপ্টার রেখে দেওয়া মোমান্দের দেশপ্রেমের গল্প
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আফগানিস্তানে দীর্ঘ ২০ বছর অবস্থান করেছেন মার্কিন সেনারা। এ সময় নিজেদের প্রয়োজনেই আফগান সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেয় তারা। এরা মূলত তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। দেশের স্বার্থ নয়, মার্কিন স্বার্থই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় ছিল। সে কারণে যখন বিদেশি সেনারা আফগানিস্তান ত্যাগ করে, তখন আফগান প্রতিরক্ষা বাহিনীরও অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যায়। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা যে বিমানে দায়িত্ব পালন করতেন, আমেরিকার নির্দেশে সেসব বিমানসহ অন্য দেশে আশ্রয় নেন। খবর বিবিসি।
মোমান্দ এখনও আফগানিস্তানের আকাশে ব্ল্যাক হক ওড়ান
মোহাম্মদ ইদ্রিস মোমান্দ এই দলের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি আফগান সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার চালানোর দায়িত্বে ছিলেন। তবে অন্যদের মতো মার্কিন সেনাদের পতনের সময় তার হেলিকপ্টার বিদেশিদের কাছে গিয়ে জমা দেননি। তার কাছে মনে হয়েছিল, এ কপ্টার দেশের সম্পদ, তাই দেশের মধ্যেই তা রাখা বাঞ্ছনীয়। ফলে অনেক হুমকি, অনেক বিপদ সত্ত্বেও তার কপ্টারটি বিদেশে নিয়ে যাননি।
এক সাক্ষাৎকারে মোমান্দ বলেন, কিছু লোক হয়তো আমার ওপর খুশি না-ও হতে পারে। কিন্তু আমার মতে, মাতৃভূমি মায়ের মতোই এবং এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা কারও জন্যই উচিত নয়। আমার লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের সম্পত্তি রক্ষা করা। তাই আমি আমার হেলিকপ্টার দেশের জন্য সংরক্ষণ করেছি।
মার্কিনীদের পতনের পর মোমান্দ তার হেলিকপ্টার নিয়ে গ্রামে চলে যান
মোহাম্মদ ইদ্রিস মোমান্দ ২০০৯ সালে আফগান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং আমেরিকান মিলিটারি একাডেমিতে চার বছরের প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। যখন তিনি প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন তখন খুব খুশি এবং উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, তার প্রশিক্ষণের পেছনে ৬০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে।
প্রশিক্ষণ লাভের পর তিনি প্রাথমিকভাবে রাশিয়ান-নির্মিত এমআই-১৭ হেলিকপ্টার চালানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি পাইলটদের একটি গ্রুপের অংশ ছিলেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ব্ল্যাক হক ওড়ানোর জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। এই সামরিক হেলিকপ্টারগুলো সরবরাহ এবং পরিবহন ভূমিকায় ব্যবহৃত হত।
কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগান সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এই আশায় যে, বিদেশি বাহিনী চলে গেলে তারাই তালেবানকে দমন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেই আশা দুরাশায় পরিণত হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বছরের এপ্রিলে মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার তারিখ নির্ধারণ করে ভাষণ দেওয়ার পর আফগান সেনাবাহিনী আশ্চর্যজনক গতিতে তালেবানদের কাছে দেশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
৬ আগস্ট তালেবান প্রথমে প্রাদেশিক রাজধানী দখল করে। তারপর দ্রুতগতিতে একের পর এক শহর, এলাকা তালেবানের হাতে চলে যায়। এমনকি ১৫ আগস্ট কোনো লড়াই ছাড়াই তালেবান কাবুল দখল করে।
আফগান সশস্ত্র বাহিনী কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। বিদেশি সেনাদের সাথে দেশটির অনেক নেতাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাইডেন তখন সেই পালিয়ে যাওয়া আফগান সরকারের নেতাদের সমালোচনা করেছিলেন। একই সাথে তিনি আফগান সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করে বলেছিলেন, প্রতিরোধের চেষ্টা না করেই তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে।
গত বছরের ১৪ আগস্টের ঘটনা স্মরণ করে ইদ্রিস মোমান্দ বলেন, যেদিন তালেবান কাবুল দখল করছিল, সে সময় পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। রাজধানী কাবুলের বিমানবন্দরটি মার্কিন সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে এটি কতক্ষণ নিরাপদ থাকবে তা নিয়ে সংশয় ছিল। সে সময় বিমান বাহিনীর কমান্ডার সব পাইলটকে নিজ নিজ বিমান-হেলিকপ্টার নিয়ে উজবেকিস্তানে উড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মোমান্দ বলেন, আমার কাছে ওই নির্দেশ ভালো লাগেনি। তাই আমি সেগুলো না মানার সিদ্ধান্ত নেই। আমার কমান্ডার আমাকে আমার দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার নির্দেশ দিচ্ছিল। আমি কেন এমন আদেশ মানব?
এ সময় মোমান্দ তার পিতার সাথে পরামর্শ করেন। তার পিতা তাকে বলেন, দেশ ছেড়ে চলে গেলে তিনি তাকে কখনোই ক্ষমা করবেন না এবং তাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, হেলিকপ্টারটি কিন্তু আফগানিস্তানের।
ততক্ষণে মোমান্দের প্রদেশ কুনার তালেবানের হাতে চলে গিয়েছিল। তার বাবা স্থানীয় গভর্নরের সাথে কথা বলেছিলেন, যিনি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, হেলিকপ্টারটি সেখানে উড়িয়ে নিয়ে গেলে তার কোনো ক্ষতি হবে না।
ইদ্রিস মোমান্দ বলেন, তবে কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। কারণ আমি যে ব্ল্যাক হক চালাতাম, তাতে চারজন ক্রু ছিল। আমি তাদের সাথে আমার ভাবনা শেয়ার করতে পারছিলাম না। কারণ আমি যে পরিকল্পনা করছিলাম, তাতে তারা রাজি হতো না। তারা আমার জীবনকে বিপন্ন করত, এমনকি হেলিকপ্টারটিও ধ্বংস করে দিত। তাই কৌশলে তাদের সরিয়ে ফেলতে হয়।
মোমান্দ বলেন, আমি কমান্ডারকে বলেছিলাম, হেলিকপ্টারটিতে কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা রয়েছে। তাই এটি ওড়ানো যাচ্ছে না। এ কথা শুনে অন্য তিন ক্রু আরেকটি হেলিকপ্টারে যোগ দেন, যেটি উজবেকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
সব হেলিকপ্টার চলে যাওয়ার পর তিনি কুনারে চলে যাওয়ার জন্য তার হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন চালু করেন। আমেরিকানরা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রণ করছিল। তাই মোমান্দ রেডিওতে তাদের বলেন, আমি উজবেকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করছি। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর আমি আমার রাডার মোড বন্ধ করে দিয়ে সোজা কুনারে চলে যাই।
আমি আমার বাড়ির কাছে আমার গ্রামে গিয়ে হেলিকপ্টার নামাই। মোমান্দ জানান, তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীরা তার সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি সমর্থন করেছেন।
মোমান্দ বলেন, এ কাজের জন্য তার কোনো অনুশোচনা নেই। তার সহকর্মী ও আমেরিকানরা তাকে তিনবার মেসেজে জানিয়েছিল, হেলিকপ্টার না আনতে পারলেও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আপনি সড়কপথে চলে আসুন। কিন্তু আমি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করিনি।
মার্কিনভিত্তিক আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য বিশেষ মহাপরিদর্শক (সিগার) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের জুনের শেষে আফগান বিমান বাহিনী জঙ্গি হেলিকপ্টার ও প্লেনসহ মোট ১৬৭টি আকাশযান পরিচালনা করছিল। এর মধ্যে অনেকগুলো মোমান্দের সহকর্মীরা উজবেকিস্তানে নিয়ে যায়। ১৬ আগস্ট উজবেকিস্তানের টারমেজ বিমানবন্দরের স্যাটেলাইট চিত্রের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে আফগানিস্তানের বিভিন্ন মডেলের দুই ডজনেরও বেশি হেলিকপ্টার ও বিমান রয়েছে।
অন্যদিকে যেসব হেলিকপ্টার বা বিমান যুক্তরাষ্ট্র সরিয়ে নিতে পারেনি, সেগুলো যতটা সম্ভব নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তবে আফগানিস্তানে এখন ব্যবহারযোগ্য সাতটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার রয়েছে। আফগান প্রকৌশলীরা তাদের সীমিত সম্পদ দিয়ে সেগুলো মেরামত করতে পেরেছিলেন। আরো কিছু ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ঠিক করছেন তারা।
মার্কিন নির্দেশ মেনে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় সহকর্মীদের দোষারোপ করে ইদ্রিস মোমান্দ বলেন, মার্কিনীদের অন্ধ অনুসরণ করে এভাবে চলে গিয়ে তারা আফগানিস্তানের বড় ক্ষতি করেছেন।
তিনি বলেন, যারা তাদের হেলিকপ্টার নিয়ে উজবেকিস্তানে উড়ে গেছে তারা আসলে দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। হেলিকপ্টারগুলো আফগানিস্তানের সম্পদ। এগুলো খুব দামি ছিল। আমার মনে হয় না আমরা সেগুলো আর কখনো ফেরত পাব।
মোমান্দকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষণের পর এখন তালেবানের পক্ষ হয়ে ব্ল্যাক হক ওড়ানোর ব্যাপারে তার অনুভূতি কী? জবাবে তিনি বলেন, সরকার সব সময়ই পরিবর্তন হয়। আমাদের মতো লোকেরা দেশ ও জাতির সেবা করে। সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নয়। কারণ দেশ আমার মতো মানুষের জন্য অনেক বিনিয়োগ করেছে।
তালেবান এক বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও কোনো দেশই তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তা নিয়ে অবশ্য মোমান্দ চিন্তা করছেন না। তিনি বলেন, আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জাতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাব।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.