ইইউর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ইউরোপের পার্লামেন্টে সমালোচনা

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ইউরোপের পার্লামেন্টে সমালোচনা করেছেন বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের সাম্প্রতিক মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সদস্যরা (এমইপি) মহাদেশীয় সংস্থাটির বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক মনোভাব, মানবাধিকার, রাশিয়া-ইউক্রেন ও অন্যান্য ইস্যুতে একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গীর অভিযোগ তুলেছেন।

জোসেফ বোরেলের মন্তব্য, মানবাধিকার ও অন্যান্য ইস্যুতে ইইউর সমালোচনা করেছেন একাধিক এমইপি

আয়ারল্যান্ড সাউথ থেকে নির্বাচিত এমইপি মাইক ওয়ালেস বলেছেন, ‘রাশিয়া যেভাবে নির্বিচার হামলা চালিয়ে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সন্ত্রস্ত করছে, আমরা কেউ সেটা সমর্থন করতে পারি না। রাশিয়াকে বিরোধিতা করার পক্ষে যুক্তি আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যখন আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ার মানুষকে সন্ত্রস্ত করে, তখন আমরা প্রতিবাদ করি না কেন? আমরা তাতে সমস্যা দেখি না কেন?’

আইরিশ এ রাজনীতিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ যখন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ইয়েমেনে ত্রাস সৃষ্টিতে সহযোগিতা করে, তখন আমাদের সমস্যা হয় না কেন? ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনিদের উপর সন্ত্রাস চালায়, তখন আমরা প্রতিবাদ করি না কেন?’

তিনি বলেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারকে শ্রদ্ধার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারো ব্যবহার যদি খারাপ হয়, যেখানেই হোক না কেন, আমাদের উচিত তার সমালোচনা করা। আমার বিশ্বাস এ সমালোচনার ক্ষেত্রে সাম্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা উচিত। কিন্তু আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। বর্তমানে ইউরোপে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে। যুদ্ধ নিয়ে কেউ যদি এমন মতপ্রকাশ করে যা এখানকার এজেন্ডার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাহলে তাকে গ্রেপ্তার হতে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আজ সকালে রোমা জনগোষ্ঠীর কথা আলোচনা করেছি। রোমার মানুষেরা ইউরোপে মানবাধিকার পায়নি। বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ইউরোপের বিপুল সংখ্যক মানুষ। আমরা ইউরোপের গরিবদের সঙ্গে ভালো আচরণ করি না। আমরা গরিবের মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই।’

স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের চলমান অধিবেশনে এমনিতে উত্তেজনার শেষ নেই। দুই বছর আগে কোভিড প্রাদুর্ভাবের সময় মার্কিন ওষুধ কোম্পানি ফাইজারের উদ্ভাবিত টিকা ক্রয়ের চুক্তিকে ঘিরে ইউরোপিয়ান কমিশন প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। ফাইজারের টিকা পরীক্ষা সম্পন্ন হবার আগে ইইউ চুক্তি করেছে, খোদ কোম্পানিটির সিইও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শুনানিতে এ কথা স্বীকার করেছেন।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলেছে ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল ফন্তেলেসের মন্তব্য। ইইউর কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তিনি নিজের পূর্বসুরী ও ইইউর আরব বিশেষজ্ঞ ফ্রেদেরিকা মগেরিনিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘ইউরোপ হচ্ছে সাজানো বাগান। পৃথিবীর অন্যান্য এলাকা হচ্ছে জঙ্গল, যা বাগানকে দখল করতে পারে। জঙ্গল ঠেকাতে দেয়াল তুলে কাজ হবে না।’

ইউরোপের বাইরে প্রজনন হার বেশি হবার দিকে ইঙ্গিত করে বোরেল বলেন, ‘জঙ্গলের বাড় বেশি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেয়াল উঁচু করা সম্ভব নয়। কাজেই বাগানকে সুরক্ষিত রাখার সেরা উপায় হলো বাগানের মানুষেরা বের হয়ে জঙ্গলে যেতে হবে, জঙ্গলকে নিজেদের বাগে আনতে হবে।’

জঙ্গলকে বাগে আনতে বোরেলের এ পরামর্শ সাবেকি দিনের মতো ইউরোপীয়দের পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে নব্য উপনিবেশ গড়ে তোলার নির্দেশনা বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একাধিক সদস্য। বোরেলের পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন একাধিক এমইপি।

বেলজিয়াম থেকে নির্বাচিত এমইপি মার্ক বোটেঙ্গা বলেন, ‘বাগান আর জঙ্গলের কথা বলে বোরেল কি বুঝাতে চেয়েছেন আমরা জানি। বাগান এমন জায়গা যেখানে সভ্য মানুষেরা হাঁটে। আর জঙ্গলে বন্য পশুরা ঘুরে বেড়ায়। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার বহু মানুষের এখনো মনে আছে কিভাবে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা সভ্যতার নামে তাদের সঙ্গে বন্য পশুর মতো আচরণ করেছে, তাদেরকে নির্যাতন করেছে, দাস বানিয়েছে, এমনকি খাঁচায় পুরে বাজারে বিক্রি করেছে, চিড়িয়াখানায় প্রদর্শন করেছে।’

বোটেঙ্গা বলেন, ‘ইইউর শীর্ষ কূটনীতিক যখন ইউরোপকে বাগান আর পৃথিবীর বাকি অংশকে জঙ্গলের সঙ্গে তুলনা করেন তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মানুষেরা এ বার্তা পান যে ইউরোপীয়রা এখনও নব্য উপনিবেশবাদী ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে আছে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না।’