সেই পাকিস্তানি সাংবাদিককে কেনিয়ায় হত্যা

পাকিস্তানের প্রথিতযশা সাংবাদিক ও টেলিভিশন উপস্থাপক আরশাদ শরীফকে কেনিয়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক মামলা ও হয়রানির শিকার হয়ে দেশ ছাড়ার কয়েক মাসের মাথায় তাকে হত্যা করা হলো। সবশেষ তিনি নওয়াজ শরীফ পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে বিহাইন্ড ক্লোজড ডোরস নামে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করছিলেন। এই প্রতিবেদনের কাজে কেনিয়ায় যাবার পর তিনি বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন।

একের পর এক মামলা ও হয়রানিতে দেশ ছাড়ার কয়েক মাসের মাথায় পাকিস্তানি সাংবাদিক আরশাদ শরীফকে কেনিয়ায় গুলিতে হত্যা করা হয়েছে

সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ এপ্রিল শাহবাজ শরীফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর থেকে আরশাদ শরীফসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে সরাসরি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ও অনলাইনে নানাভাবে হয়রানি করা হতে থাকে। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল বলে মন্তব্য করায় মে মাসে আরশাদ শরীফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়।

পাকিস্তানের নতুন সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সব ধরনের ভাষণ ও জনসভার খবর প্রচারে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ অবস্থায় আরশাদ শরীফ ও তার চ্যানেল আরি টিভি ইমরান খানের বক্তৃতার লাইভ সম্প্রচার অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে আরশাদ শরীফকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

আরশাদ শরীফ ছাড়াও বোল নিউজের সাংবাদিক সামি আব্রাহাম, এক্সপ্রেস নিউজের উপস্থাপক ইমরান রিয়াজ খান ও আরি টিভির উপস্থাপক শাকিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অনেকগুলো মামলা দায়ের করে শাহবাজ শরীফ সরকার। ইমরান রিয়াজ খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদের বাড়িতে ও কর্মস্থলে বিভিন্ন সময়ে গভীর রাতে হানা দিতে থাকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ও কেন্দ্রীয় তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফআইএর কর্মকর্তারা।

এরইমধ্যে আরি টিভির মালিকসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি আরশাদ শরীফকে চাকরিচ্যুত করে। আরশাদ শরীফ জামিনে মুক্তি পেয়ে বোল নিউজে যোগ দেন। কিছুদিন পর তিনি জীবনের নিরাপত্তার প্রতি হুমকির কথা জানিয়ে দেশ ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যান।

দেশ ছাড়লেও আরশাদ শরীফ সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখেন এবং সামাজিক মাধ্যমেও পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে সরব ছিলেন। সর্বশেষ তিনি নওয়াজ শরীফ পরিবারের অর্থপাচার, বিভিন্ন অফশোর টেরিটোরিতে শেল কোম্পানি গঠন এবং ওইসব কোম্পানির মাধ্যমে লন্ডনে সম্পদ ক্রয় নিয়ে বিহাইন্ড ক্লোজড ডোরস নামে একটি অনুসন্ধানী সিরিজের কাজ করছিলেন। গত সপ্তাহে সিরিজটির টিজার রিলিজ করা হয়।

পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় রাজনীতিক, মুক্তমনা সেলিব্রিটি ও সাধারণ মানুষরা আরশাদ শরীফ হত্যার খবরে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ও সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার নামোল্লেখ করে অনেকে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন।

স্যাটায়ারিস্ট সাইথ আবদুল্লাহ লেখেছেন, কেনিয়া পুলিশ বলেছে আরশাদ শরীফের মাথায় স্নাইপারের গুলি ছিল। কে বা কারা স্নাইপার নিয়োগ করেছে? কারা এসব পরিকল্পনা করেছে? হত্যার মোটিভ কি হতে পারে? তাদের বিরুদ্ধে আরশাদ শরীফের কাছে কি প্রমাণ ছিল? হাজী অ্যান্ড কোম্পানি এসব প্রশ্নের জবাব দেন।

আরশাদ শরীফের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। এর জবাবে সাংবাদিক মুজাম্মিল হাসান প্রধানমন্ত্রীকে ট্যাগ করে লেখেছেন, এটা মৃত্যু নয়, ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড। অবাক হচ্ছি যে বিদেশের মাটিতে দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকের হত্যার ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ না দিয়ে আপনি টুইটারে শোক জানাচ্ছেন। স্যার আমরা ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। আমার মনে হয় এটা আপনার জন্য ভালো হবে না।

পাকিস্তানের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী শিরিন মাজারি বলেছেন, কেনিয়া পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে আরশাদ শরীফকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে স্নাইপাররা। আরশাদ আমাকে বলেছিলেন যে তাকে হত্যার জন্য ‘হেড মানি’ ঘোষিত হবার পর তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। পরবর্তীতে তিনি আমিরাত ছেড়ে লন্ডন যান। আমিরাত ছাড়ার পর আরশাদ জানান, ওরা নাকি দুবাইতে তার খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল।

পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাজহার আব্বাস ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস ও সিপিজের প্রতি আরশাদ শরীফ হত্যার ঘটনা উদঘাটনে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।